Last Updated on November 4, 2021 4:59 AM by Khabar365Din
রিপোর্ট █ ইন্দ্রনীল সাহা
ছবি █ অমিত ধর
৩৬৫দিন। কলকাতার কাবাব প্রেমীর নস্টালজিয়া নিয়ে স্বমহিমায় ফিরল নিজামস। নতুন রূপে হলেও ঐতিহ্য ও কাবাব ঘরানায় আগের ফ্লেভারই ধরে রেখেছে তারা। নিজামস নামটা বলতে প্রথম যে খাবারটার কথা মাথায় আসে তা হল বিফ কাবাব কিংবা বিফ রোল। নিজামের বিফের প্রেমে পড়েনি এমন বাঙালি খুবই কমই আছে। এ প্রসঙ্গে নিজামসের কর্ণধার সমর নাগ বলেন, শুধু মুসলমানই নয়, ৮০ শতাংশ অমুসলিমরাই নিজামের বিফ কাবাব খেতে আসেন। প্রায় ১৩ বছর বাদে গত শুক্রবার থেকে আবার নিজামসে বিফ পাওয়া যাচ্ছে। বিফের টানেই বহু বাঙালি আবার ভিড় বাড়াচ্ছে রেস্তোরাঁয়। ১৯৩২ সালে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় নিজামসের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই আপামোর বাঙালি বিফ কাবাব, বিফ কাঠি রোল, বিফ বিরিয়ানিতে মজেছিল। বাংলা ও বাঙালির পরিপূরক হয়ে উঠেছিল নিজামস। কিন্তু নিজামসের বারবার মালিকানার হাতবদল এবং শহরজুড়ে একের পর এক মোগলাই রেস্তোরাঁ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠায় প্রতিযোগিতার বাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল । ১৩ বছর আগেই বন্ধ হয়ে যায় বিফের বিক্রিও। শুধুমাত্র, আর পাঁচটা মোগলাই রেস্তোরাঁর খাবারই মিলত। কিন্তু বিফ ছাড়া নিজামস! ভাবাই যায় না। নিজামসের অধীনে মূল রেস্তোরাঁর পিছনেই মুঘল গার্ডেন নামে রেস্তোরাঁতেই মিলত বিফের নানারকম ডিস। এবার সেই রেস্তোরাঁর নাম বদলে নিজামস করা হল। একই সঙ্গে নিজামসের মূল রেস্তোরাঁরও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পপতি সমর নাগের উদ্যোগে একেবারে খোল নলচে বদলে নতুনভাবে সেজে উঠেছে নিজামস। দেওয়ালে ঝুলছে, সত্যজিৎ রায়, হৃত্বিক ঘটক থেকে পুরনো কলকাতার সাদা কালো ছবি। আধুনিক মোড়কে মোরা হলেও নিজামস যেন তার ঐতিহ্যকে প্রতি পরোতে পরোতে ধরে রেখেছে। মেনুতে যোগ হয়েছে বেশকিছু নতুন ডিস। যেমন সুফিয়ানি বিরিয়ানি, বিফ রারা তাজাকি, টার্কিশ ব্রেড, বেগম পসন্দ মালাই, খিরি রোলের মতো বেশ কিছু জিভে জল আনা মোঘলাই খানা। বিফ রারা তাজাকি মূলত তাজাকিস্তানের খাবার হলেও নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্টের পর এই বিশেষ মোগলাই খাবারকে তৈরি করেছে। এছাড়াও এখ ন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সুফিয়ানী বিরিয়ানি। যাকে হোয়াইট বিরিয়ানি বলা হচ্ছে। পাশাপাশি তুর্কির বিশেষ রুটি যা টার্কিশ ব্রেড নামে পরিচিত। রূমালী রুটি, নান কিংবা পরোটার পাশাপাশি টার্কিশ ব্রেডেও ধীরে ধীরে গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করছে। শেষ পাতে ডেজার্ট আইটেমে যোগ হয়েছে, বেগম পসন্দ মালাই। নিজামসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সৌমিক দলুই বলেন, বিফের পুরোনো আইটেম যেমন থাকছে তেমনই বেশকিছু নতুন বিদেশি মোগলাই খানা কেও আমরা আমাদের মেনুতে নিয়ে এসেছি। আরো বেশ কিছু খাবারের আইটেম খুব শীঘ্রই আমরা আনবো। নতুন যে আইটেমগুলো আমরা এনেছি এগুলো শুধু বিফে নয়, চিকেন কিংবা মটনের সঙ্গেও পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে,বহু বাঙালি বিফ অপছন্দ করেন। সেই কথা মাথায় রেখেই বিফ আইটেম তৈরি করার জন্য এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁর কিচেনটাও সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে। যার সঙ্গে মূল রেস্তোরাঁর কোনো যোগ নেই। অর্থাৎ যেসব খাদ্য রসিক বাঙালিরা বিফ খেতে চান না তাদের জন্য আগের মতোই লোভনীয় মটন বিরিয়ানি, চিকেন রেজালা কিংবা নানা ধরনের কাবাবও থাকছে। নিজামসের বিফের স্বাদ পেতে হাজির হয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার অরূপ দাস ও তার স্ত্রী শম্পা দাস। নরম তুলতুলে বিফ কাবাব এর কামড় দিতে দিতেই তারা বললেন, বহু বছর বাদে আবার অতুলনীয় বিফের স্বাদ পেলাম। কলকাতার বহু রেস্তোরাঁয় বিফ পাওয়া গেলেও নিজামসের স্বাদটাই আলাদা। বেঁচে থাকুক নিজাম।

সত্তর দশকের দামাল স্মৃতি ফিরে এল স্বাগত নিজামস্-এর বিফ
পূষন গুপ্ত
সত্তর দশক ছিল নকশালদের কাছে মুক্তির দশক আর আমাদের মতো বন্য দামাল বেপরোয়াদের কাছে আগুনখেকোদের দশক। শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছি তখন। ধর্মতলায় অতো কম পয়সায় পেটভরা অতো সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য কেবল নিজামের বিফ। সে রোলই হোক, আর কাবাবই হোক, অথবা ভুনা… বিফ হলেই হল। পরবর্তীকালে বাঙালি তরুণ-তরুণীরা সস্তায় পাওয়া যায় বলে এগরোল বা ভেজ রোলের দিকে ঝোঁকে। ইদানিং ওরা আবার পনিরও খায়। কোনদিন দেখব পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের মতো ঘাস সেদ্ধ করে খাচ্ছে। আহা বেচারা….

নিজামের ডবল কাঠি আন্ডা বিফ
রোল এত বড় ছিল সেই রোল
এক হাতে ধরা সম্ভব হত না
অভিজিৎ অধিকারী
আমার স্মরণীয় দুঃখের দিনগুলির মধ্যে একটি নিজামের টেবিলে বসে। মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম বিফ রোল খাওয়াবো বলে। গিয়ে শুনলাম নিজামে বিফ উঠে গেছে। মাঝে দোকান কি সব গন্ডগোলের জন্য বন্ধ ছিল অনেকদিন। দু-একবার গিয়ে ফিরেও এসেছি। কিন্তু তাই বলে নতুন করে দোকান খোলার পর নিজামের ঝকঝকে দেয়ালে যে নো বিফ সাইনবোর্ড ঝুলবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। মনে হলো, শৈশবটা ঝাপসা করে দিলো কেউ। তখন ক্লাস ফোর কী, ফাইভে পড়ি। বাবার সঙ্গে নিজামে গেছি। বাবা অর্ডার দিলেন ডবল কাঠি আন্ডা রোল। একহাতে ধরা যেত না সেই ডবল কাঠি আন্ডা রোল। ধরতে দুহাত লাগতো। গনগনে চুলোর ধোঁয়ায়, কালো হয়ে যাওয়া হলদেটে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে, নিজামের সস্তার টেবিল চেয়ারে বসে তেল চপচপে ডিম পরোটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মসলা মাখানো বিফ কাবাবে প্রথম কামড়ের কথা ভাবলে চোখে আজও জল ভরে আসে। সেসময় কত দাম ছিল জানিনা। পরে একটু বড় হওয়ার পর মনে আছে যখন নিজামের বিফ রোলের দাম দু টাকা থেকে বেড়ে আড়াই টাকা হলো সেদিন আমরা সব বন্ধুরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। বিফ তো আর খাওয়া যাবেনা, আলু রোলই খেতে হবে। আলু রোল তখনও ৬০ পয়সা। সত্তর দশকের তখন উত্তাল সময়। শহরের সব দেওয়াল বিপ্লবের ডাকে রক্ত লাল। আগুনখেকো, দামাল ছাত্ররা দূষিত,পচে যাওয়া সমাজটাকে পাল্টে একটা নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। কেউ সংসদকে বলে শুয়োরের খোয়াড়। কেউ তার বিরোধিতা করে মুখোমুখি, মাথায় মাথা লাগিয়ে। কফি হাউজের ইনফিউশন আর নিজামের বিফ রোল দুপক্ষেরই সমান ফেভারিট। গোমাংস নিয়ে আমার পরিবারে রক্ষণশীলতা ছিলনা। কিন্তু আমার চেনাজানা বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগই নিজামে গিয়ে বিফ রোল খেত, বাড়িতে না জানিয়ে। তবে যদিবা পরে বাড়িতে জেনেছে তাহলেও জাত গেল জাত গেল বলে এমন হা হুতাশ হয়নি, এখন যা হচ্ছে। দেশের কোথাও গোমাংস নিষিদ্ধ ছিল। না। অশিক্ষিত, বর্বর প্রকৃতির এই শাসকদলের আগমনের আগে পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের খাদ্যাভ্যাসে কেউ ক্ষমতার জোর খাটায় নি। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলা গেরুয়া মুক্ত। ধর্মের দোহাই দিয়ে খাদ্যাভ্যাসের উপর ক্ষমতার থাবা বসানোর কেউ নেই। বরং আমরা যে ছাতার তলায় রয়েছি সেখানে কেউ থাবা বসাতে এলে তার হাত দুটো মট করে ভেঙে দেবে প্রশাসন। তাই নিজামে আবার সগৌরবে ফিরে আসতে পারে বিফ রোল। সদর্পে দেওয়াল থেকে খুলে নিতে পারে নো বিফ লেখা সাইনবোর্ড। আমরা যারা বিফ ভক্ত এবং ধর্মের গোঁড়ামি মানি না, স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারি।

বিফ রোল খেতে খেতেই
রক্তমাংসের নায়িকা অপর্ণা সেনকে সেই প্রথম দেখি
অনিরুদ্ধ ধর
সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। বিফ খাওয়ার সুযোগ আসেনি। সেবার কলকাতায় ছুটিতে এসেছি। শীতের সময়। কলকাতায় তখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলছে। সিনেমার প্রতি টানটা ছিলই, ও চুটিয়ে বিদেশি ছবি দেখছি বন্ধুদের সঙ্গে। সোসাইটি হলে গোদারের ছবি দেখে, এক বন্ধু প্রায় টানতে টানতে প্রথমবার নিজামে নিয়ে গেল। এমনিতেই খাওয়ায় কোনও মার্গ ছিল না। ফলে কাবাব রোল হাতে চালে এল। প্রথম কামড়েই প্রেমে পড়ে গেলাম। নিজামের জানলার ধারে একটা টেবিল ছিল। ওখানেই বসতাম। আমার ভীষণ প্রিয় জায়গা। পরোটা আর কাবার নিয়ে বসেছি হটাৎ জানলার বাইরে চোখ পড়তেই দেখি অপর্ণা সেন যাচ্ছেন। বোধহয় উনিও কোনও সিনেমা দেখে নিউমার্কেট ঘুরে ফিরছেন। সিনেমার পর্দায় আমি দারুন ফ্যান ছিলাম ওনার। রক্ত মাংসের অপর্ণা সেনকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়াটা তখন আমার কাছে স্বপ্নের মত। এর পরেও অসংখ্যবার ওই ধর্মতলা চত্তরে সিনেমা দেখতে গিয়ে কিংবা কাজে অকাজে নানা ছুতোয় নিজামের রোলে, কাবাবে মজেছি। ধর্মতলা কিংবা ওই চত্তরে যাওয়া মানেই কাবাব অথবা রোল খাওয়াটা অলিখিত অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বছর আষ্টেক আগেও দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের নিজামের সামনে হাজির হয়েছিলাম। অত্যন্ত যন্ত্রণার সঙ্গে আলু রোল যেয়ে ফিরতে হয়েছে। আবার নিজাম বিষ্ণু বোন আনছে শুনে পা টানছে বর্মলা। পাস্তানিকের ঝামেলা মিটলেই ছুটব। তবে ওই জানলাটা আর টানে না, হাত বাস হচ্ছে বলে রোমান্টিকতা কমে আসছে, শুধু স্মৃতিটুকু আজও অকূলে রয়ে গিয়েছে।

নিজে খাদ্যরসিক নই, তবু
প্রবাসী বাঙালিদের মুখে আজও নিজামের গল্প শুনি
সুবোধ সরকার
তেমন কোনও বিরাট অভিজ্ঞতা নেই। তবে দীর্ঘ দিন খাদ্য রসিকদের রসনাকে সিক্ত করে এসেছে নিজাম। অবশ্যই কলকাটা শহরের খ দ্যপ্রেমীদের কাছে ওদের রোল, কাবাব সমাদৃত। ১৯৩৯ সালে কাঠি কাবাব ওদেরই আবিষ্কার। খাদ্যের বিবর্তনে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সমর নাগ একজন দক্ষ ব্যবসায়ী, দক্ষ পরিচালন ক্ষমতা ওনার। তিনি দায়িত্ব নিয়ে আবার স্বমহিমায় এই ব্র্যান্ডকে তাঁর আগের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে দেবেন এটা আশা করি। কলকাতার বাইরেও নিজামের রোলের খ্যাতি আমি শুনেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানেই কলকাতার ছেলে মেয়েরা গত ৩০,৪০ বছরে ছড়িয়ে আছে, তাদের কাছেও নিজামের এই বিখ্যাত খাবারের স্মৃতিকথা শুনেছি,জনপ্রিয়তার আঁচ পেয়েছি। কলকাতা সেই অর্থে শিল্প ও সংস্কৃতি ছাড়াও খ দ্য নগরীও বটে। বিশ্বের হেন দেশের খাবার নেই যা এখ টানে মেলে না। আফগান থেকে ইতালিয়ান, চীন থেকে ব্রিটিশ বিস্তৃত এই খাদ্য সংস্কৃতির বর্নময়তার জন্য গর্বিত বোধ করি।

আমার কাছে যুগলবন্দির অর্থ
নিউ এম্পায়ারে ক্লিন্ট ইস্টুড নিজামের বিফ রোল
নচিকেতা
আমাদের স্কুল কিংবা কলেজ লাইফে পকেটমানি মিলিত অনেক কষ্ট করে। বড়দের হাত দিয়ে পয়সা গলতে চাইত না। তাই পার্ক স্ট্রিটের আলো চমকানো রেস্টুরেন্ট ছিল আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওটা ছিল বড়লোকের বেটাদের জায়গা। আর কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা হয়ে গঙ্গার ঘাট ছিল আমাদের, মনে আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসছি, তাদের রাজত্ব। ন্যাকা প্রেম চিরকালই অপছন্দ ছিল, তাই গঙ্গার ঘাটে খহয়তো তোমারই জন্য/ হয়েছি প্রেমে বন্যখ আমার হয়নি। তার চেয়ে কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউজ, উত্তমদার চায়ের ঠেক কিংবা বইয়ের আঠার গন্ধমাখা অলি গলি রাজপথ বেশি কাছের। এই ভূ মিকার দরকার ছিল নিজামের গল্প বলার জন্য। আগে তখনও বিফ খাইনি। আমার বন্ধু বাপি প্রথম আমায় নিজামের স্বাদ দেয়। পাঁচ টাকা পকেটে নিয়েও যে ধর্মতলা চত্বরে রাজত্ব করা যায়, সেই প্রথম জানলাম। নিউ এমপ্যায়ারে ম্যাটেনি শো, ক্লিনট ইস্টুডের মার কাটরি টেক্সাস কাউবয় ফিল্ম, আর ফেরার পথে নিজামের বিফ কাঠি রোল। এ যুগলবন্দী ভোলার নয়। গরম কাগজের মোড়ক পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে জাপটে আছি,ভিতরের উত্তাপে হাতের তালু পর্যন্ত গরম হয়ে উঠছে। ভিতরের পিয়াজ আর কাঁচা লংকার সহবাসে পাতিলেবুর সোহাগ। প্রথম কামড়টা দিতেই মুচমুচে পরোটার পরত টপকে তুলতুলে হয়ে আসা বিফের টুকরোকে ছোঁয়া যেত। তারপর মুখের ভিতরে পরোটার সঙ্গে মিশে যাওয়া নরম বিফের স্বাদ, ততক্ষনে হেঁটে ট্রাম লাইনে এসে গিয়েছি। গোটা রাস্তাটা নিজামের স্পেশাল একটা মশলার স্বাদ বয়ে নিয়ে ফিরতাম। এ স্বাদের ভাগ হবে না। এত বছর পরে আবার নিজামের বিফ রোল ফিরছে শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে। পুরানো স্মৃতি গুলো ফিরে আসছে। এখন খুব মেপে খাই। অনেক কিছু খাবার বারণ। ডাল আর আলুপোস্ত হলে আর কিছু লাগে না। যারা বিফ রসিক রয়েছেন অবশ্যই তাদের জন্য সুখবর। তরুণ প্রজন্ম এসব খায় কিনা জানি না। ওরা স্বাস্থ্য সম্পর্কে, হাইজিন নিয়ে অনেক সচেতন। ম্যাগি কিংবা সিদ্ধ মোমো হলেই ওদের হয়ে যায়। আমরা খাওয়ার বিষয়ে এডভেঞ্চারাস ছিলাম। ওরা ভেগানে বিশ্বাসী। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায় তো তাই দেখি। সুস্থ থাকাটাই আসল। ওরা যদি সুস্থ থাকতে ঘাস পাতাও খায়, কিছু বলার নেই।

ব্রিগেডে বামেদের মিটিং শেষে
১ টাকায় বিফ কাঠি রোল আর পরোটা কাবাব
পাচু রায়
আমার অফিস ছিল ৩ কিড স্ট্রিটে- এমএলএ হোস্টেলের পাশের বাড়িতে। ৩৪বছর চারমাস কাজ করেছি ওই বাড়িতে। একটানা। ১৯৬৮ সালে চাকরিতে জয়েন করি। ২০০২ সালে রিটায়ার। টানা ৩৪বছর চারমাস। তো কিড স্ট্রিট মানে তো নিউ মার্কেট চত্বর। কিড স্ট্রিটের পাশে ভুবনবিখ্যাত ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দু’পাশে সারি সারি রোলের দোকান। আর রোল বলতে তো ওই অঞ্চলে শুধুই বিফ রোল। আবার কিড স্ট্রিট মানে তো যমুনা সিনেমা-গ্লোব সিনেমা-টাইগার এলিট-লাইট হাউস-নিউ এম্পায়ার-যমুনা লাগোয়া কাঠিরোল আর এলিট লাগোয়া নিজামের রোল। নিজামের রোল! এমন বন্ধু আর কে আছে-তোমার মতন মিস্টার! তবু বিফ রোলে আমার হাতেখড়ি কিন্তু নিজামে নয়। হাতেখড়ি যমুনা লাগোয়া দোকানটায়। আমার অফিস থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ছিল সেই দোকান। ৫০ পয়সায় একটা বিফ রোল। সেখানে দুপুরে দু’টো রোল খেয়ে টিফিন সেরেছি কতদিন। হাতে গরম দু’টো বিফ রোল স্রেফ একটাকায় তখন, ভাবা যায়! তবে এটা কবুল করতেই হবে যে, যমুনার পাশের দোকানের রোলের তুলনায় নিজামের রোল ছিল অনেক টেস্টি। মাংসটা চিবিয়ে চিবিয়ে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া যেত। আর কবুল করতে লজ্জা নেই, নিজামের মতো কেবিন আর ছিল কোথায়! কাঠের সুইংডোর কেবিন। শুধু মজাই মজা। কাঠি রোল আর বটি কাবাব। অল বিফ। ৬৮-৬৯ সালে যখন বিফ রোল খাওয়া ধরি তখন নিউ মার্কেটে গরুর বোনলেস মাংস ছিল ১টাকা কিলো। ১৯৮০-৮৫সাল পর্যন্ত ওটা ২-৩ টাকা ছিল। তখন বাড়িতে গরুর মাংসের চল ছিল আমাদের। আমার বউ গরু খেত না। আমার বড় মেয়েও খুব পছন্দ করত না। কিন্তু আমি আর আমার ছোট মেয়ের ফেবারিট ছিল বিফ। আমার ছোট ভাইয়েরও। কিন্তু নিউ মার্কেট চত্বরে নিজামের বিফ রোল ছিল এক ধরনের ট্যাবু। এমনটাই বলা যেতে পারে। ষাটের দশক বা সত্তরের শুরুতে যখন আমি প্রবল সিপিএম তখন মনুমেন্টের তলার ময়দানে বা পরে ব্রিগেডের জনসভায় শামিল হওয়ার পর অনিবার্য ধারাপাতে ছিল নিজাম। নিজামের বিফ রোল আর চা। দামে সস্তা তো বটেই। ভরপুর এনার্জিতেও টইটম্বুর। ময়দানে মিটিংয়ের পর বিফ রোল না খেলে যেন মিটিংটাই থাকত অসম্পূর্ণ। মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘আমাদের গেছে যে দিন চিরকালই কি গেছে/কিছুই কি নেই বাকি!’

নিজামে উৎপল কুমার বসু
একটা বিফ রোল ৪ টুকরো করে খাওয়া শেখালেন
প্রশান্ত মাজি
আমরা নাড়া বেঁধেছিলুম কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের সঙ্গে। এমনকি সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের হাউজ এর সঙ্গে নয় ।তাকে মনে হতো একটু বড় লোকের বিটি। এখন কথা হলো যে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে আমরা একটি চন্ডী মন্ডপ বানিয়ে নিয়েছিলুম। তার মাঝখানে পাইপ মুখে বসে থাকতেন উড়োনচন্ডী এক কবি উৎপলকুমার বসু । বলতেন, পাইপটা কাউকে অফার করতে হয় না, এটা বিরাট সুবিধা, তাই না ? সেই পয়সায় ইনফিউশন খাই আসুন। বলে তিনটে ইনফিউশন অর্ডার দিলেন। টেবিলে দেখি অন্তত সাতজন। এই জল ঢেলে ভাগ করে খেতে খেতে খেতে একদিন ফেড আপ হয়ে গেলাম। উৎপল বললেন কানে কানে, আগামী কাল নিজামে রোল খাওয়াবো। আসবেন ? নিজাম ? রোল ? কে না রাজী হয় বলুন ? হলো কী, নিজামের সেদিন নির্ধারিত সময়ে গিয়ে দেখি, উৎপল বসে আছেন। সঙ্গে আরও দুজন। আমি তো মেস থেকে রাতে মিল অফ করে গেছি, রোল খেয়ে পেট ভরে যাবে বলে। ও বাবা, আমি যাওয়া মাত্রই দেখি চমৎকার ঝকঝকে প্লেটে একটি রোল কাগজ ঢাকা দিয়ে এলো বটে, চারটে টুকরো করা। সেই নির্দেশ উৎপল ওয়েটারকে আগেই দিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর ! একটা করে টুকরো তুলে নিয়ে খেতে থাকি আর ভাবি, আহ, একটা আস্ত রোল কবে খাব ? এটা কি ঠিক করলেন উৎপল ? কফি হাউজের ভাগ করা ইন ফিউশন আর নিজামের চার টুকরোর এক টুকরো রোল, ব্যাপারটাতো সেই এক ই থেকে গেল। উৎপল লিখেছিলেন যদি দ্বিখন্ড হয়েছ আজ একদিন শত টুকরো হবে কফিই হোক বা নিজাম এর রোল হোক,উৎপলকুমার বসু আমাদের সকলকে ভাগ করে খেতে শিখিয়েছিলেন।

ঋষি, ব্রাহ্মণরাও গো ভক্ষণ করতেন
বৈদিক যুগে বৃষ আহুতি দেওয়া হতো
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি
আমাদের খুব ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রাণীর রচনা লিখতে হত তার মধ্যে সিংহ-ব্যাঘের সঙ্গে গরু কিংবা কুকুরও ছিল। গরুর প্রচনা লিখতে অবশ্য আমার খুবই ভালো লাগত। তার চারটি পা, একটি লেজ, দুটি শিঙের সঙ্গে যখন সমস্ত প্রাণী-বিলক্ষণ গরু গলকম্বলটি এমন একটা পয়েন্ট ছিল, যা না লিখলে এক নম্বর নিশ্চয়ই কমে যেত। নন্দর নাম পাওয়ার আর একটি বড় জায়গা ছিল গরুর গবর্ণনা-গরুর দুধে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার শারীরিক পুষ্টি হয়, এই বিশ্ববিদিত সত্য উচ্চারণের পর গরুর চামড়াও আমাদের খুব কাজে লাগে এটা হাত আমাদের রচনার শেষ পদ্ধক্তি। বক্তৃত ওই যে গরুর বুধের কথাটা বললাম এই দুধের ‘কনসেপ্টটাই ভারতবর্ষে গরুর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দুই রকম করে দিয়েছে। বস্তুত সেটা এক মহাকালকে হারিয়ে অন্যতর এক মহাকাল তৈরি করে দিয়েছে। এটা কিন্তু ভীষ্ম এক আশ্চর্য যে, আমাদের প্রাচীনতম গ্রন্থ যে খাবেন, সেখানে দুটি চরম বক্তব্য শুনতে পাই গরু সম্বন্ধে। গরু শব্দের পর্যায়বাচক একটি শব্দ অদ্ভুত ষোলো বার ব্যবহার করা হয়েছে ঋগবেদে এবং এই শব্দটি ছাগহীনভাবে জানায় যে, গরুকে কখনোই মারা যাবে না। সেই জন্য তার অন্য নামই হল ‘অগ্ন’। ঋগবেদের যে মন্ত্রের মধ্যে এই ‘অগ্ন’ কথাটা আছে, সেখানে অবশ্যই গাকের দুধের গুরুভুটা ধরা পড়ে এবং যেখানে যেভাবে শব্দটির প্রয়াগে ঘটেছে। সেখানে বেশ একটা পারিবারিক চিত্র ধরা পড়ে, যাতে বাঝো যায় এই গরুটির ওপর সমস্ত পরিবারের মায়া পড়ে গেছে বাস্তবেও এটা আমি দেখেছি যে, মরুর মতো এমন একটা নির্বুদ্ধি, নিরীহ এবং একাধারে এমন এক বৃহৎ প্রাণীকে মেরে ফেলতে মায়াই লাগার কথা। আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এদেশে এসেছিলাম, তখন আমাদের গরুটি এক হাজি সাহেবের কাছে দিয়ে আসা হয়েছিল। হাজি সাহেব আমার পিতৃবন্ধু ছিলেন এবং কথা দিয়েছিলেন যে, দুধের প্রয়াজেনটাই তাঁর বেশি, তিনি যত্নে রাখবেন গরুটিকে। কিন্তু এই হাত বদল হওয়া গরুটির কিন্তু আমাদের চলে আসাটা বুঝতে পারছিল, সেই পোষা গরুর চোখে জল পড়তে দেখে আমার মা কেঁদে ফেলেছিলেন ঋগবেদে যেখানে দুগ্ধবতী গাভী মাত্রেই তাতে ‘আম’ বলা হচ্ছে, সেখানে যেন এই পারিবারিক মায়া আছে। এটি পোষা গরু, সেকালের জর্ষিরা তাঁদের প্রাত্যহিক অগ্নিহাত্রে যাগ করার জন্য এবং অবশ্যই পারিবারিক পুষ্টির জন্য অনেকেই এক পুষতেন। আর বশিষ্ঠমুনির শাতেজ্ঞাপূরক কামধেনুটি তো এতই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল যে, সেটা পাবার জন্য বিশ্বামিত্র মুনি মুগ্ধ করেছেন বশিষ্ঠের সঙ্গে।
পারিবারিক দুগ্ধপুষ্টির জন্য পাণ্ডব-কৌরবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য গ্রাম থেকে আমাত্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কিন্তু একটা গরুও তিনি পাননি। কেননা যার গরু থাকত, সে গরুকে তার সম্পদ হিসেবে গণ্য করত। আর এমনিতেও কৃষি শিক্ষাহীন পশুপালক আর্মানের কাছে গো-পালন অনেক সময়েই বিনিময়ের মুলো চিহ্নিত হত। সেকালের প্রায় প্রত্যেকটি রাজা গো-পালনের জন্য পৃথক ‘ভূমি’র ব্যবস্থা রাখতেন যাতে ‘গোধন’ বাড়ানো যায়। আর্যদের মধ্যে বৈশ্য জনজাতির বৃত্তি ছিল—“কৃষি-গোরক্ষা-বাণিজ্যম। সবার ওপরে আছেন আমাদের গিরিরাজ গোবর্ধন গোবর্ধন শব্দটাই তো গরু বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু এত যে গোরস্পা-গোবর্ধন, তার সবার মূলে আছে দুধের পুষ্টি যাতে গরুণা একটা পর্যায়বাচক শব্দ তৈরি হয়েছে গরুকে কখনোই মারা উচিত নয় বলেই তার নাম ‘অম্ল। ঋগবেদের মন্ত্রে প্রার্থনা করা হচ্ছে- হে হত্যার অ্যাগো অহননীয়া গাভী। তুমি শোভন শস্য-তৃণাদি ভক্ষণ করো এবং প্রভূত দুগ্ধবতী হও। তাহলে আমরাও প্রভূত ধনবান হব। সর্বকাল ধরে তৃণমূল ভক্ষণ করো এবং সর্বর গমন করে নির্মল। জল পান করো—–সুয়বসাদ ভগবর্তী হি ভুয়া অর্থে বয়ং ভগবস্ত্রো স্যাম। অদ্ধি তৃণম আয়ে বিশ্বানীং পিব শুদ্ধমুকমারী। বর্তী গাভী কখনও হত্যার যোগ্য নায়-এমন ঘোষণা সমস্ত বো-ব্রাহ্মণে বারবার উচ্চারিত হলেও বৈদিক কালের মানুষ। সামনকী ঋষি-ব্রাহ্মণেরাও গরু খেতেন না এমন নয়। শতপথ ব্রাহ্মাণের মতো অতিপ্রাচীন এক ব্রাহ্মণগ্রন্থ, যা অন্তত আটশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা হয়েছে, সেখানে এক যজ্ঞেশালায় ঋত্বিক পুরোহিত প্রবেশ করাচ্ছেন তাঁকে, যিনি যজ্ঞব্রত গ্রহণ করেছেন। প্রথমেই তার উদ্দেশে মালিকের বক্তব্য হল- তুমি যজ্ঞ করতে এসেছ, আর যজ্ঞ যে করবে সে যেন গরু কিংবা হাঁড় না যায়, কেননা গরু এবং যাঁড় এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দেবতারা অন্যান্য সমস্ত প্রাণীর প্রাণশক্তি গরু এবং যাঁড়ের মধ্যে দিয়েছেন। অতএব এই দুটি প্রাণীকে খেয়ো না। খেলে মহাপাপ হবে। এই এক অনুচ্ছেদ ধরে গোমাংস ভক্ষণের সম্বন্ধে পাপ উচ্চারণ করার পর একেবারে শেষ পক্তিতে হঠাই এক নামী ঋষির স্পষ্ট উচ্চারণ শানো গেল, (সে তোমরা যে যাই বলো) গোমাংস ব্যাপারটা বান্না করার পর যদি বেশ তুলতুলে নরম হয়, তাহলেই আমি সেটা পছন্দ করি—তদু হাবোচ যাজ্ঞবন্ধ্যো অধ্যাম্যেবাহ অমৎসলং চেলুবতি। যালবজ্জোর এই ছোট্ট কথাটা থেকে বেশ বোঝা যায় যে, পূর্বপ্রচলিত গোমাংস ভক্ষনের স্বাদ এখনও তার মুখে বেশ লেগে আছে এবং যত নিষিদ্ধই হাকে এখনও তিনি সে মাংস খান। আমার বলতে বাধা নেই পরিপূর্ণ বৈদিক কালে যে বিরাট যাগ-যজার আড়ম্বর তৈরি হয়েছিল, সেখানে যজ্ঞে পশুবধ করে তার মাংস নেবোদ্দেশ্যে আন্ততি দেওয়াটাও অন্যতম আড়ম্বর হিসেবে গণ্য হত। এই পশুর মধ্যে অন্যতম ছিল গরু। আর যাঁড় তো বার বার উচ্চারিত হয়েছে হাঙ্গীয় পশু হিসেবে। ঋগবেদের একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, ইন্দ্রেরও আসার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসেননি। এই অবস্থায় বসুক্রের স্ত্রী একটু দুঃখ করেই বলছেন— সমস্ত প্রভুসম্মিত দেবতারাই এই যজ্ঞে এলেন, কিন্তু আমার শ্বশুরমশাই ইন্দ্র এলেন না। যদি আসতেন তিনি, তাহলে ঘিয়ে ভাজা যবের ছাতু খেতে পেতেন, সোমরসও পান করতে পারতেন–জঙ্কীয়াদ থানা উত সামেং পপীয়াৎ। (ইন্দ্রের পুত্রবধূ এখনও আশা ছাড়েননি, তিনি শশুরের উদ্দেশে বলেছেন— ) পাথরের ওপর ছেঁচে যাঁরা সোমরস তৈরি করেন, সেই সোমরস তুমি পান করো, তারা অনেক ষাঁড়ের মাংস রান্না করেছেন, তুমি তা ভোজন করো –পচস্তি তে কৃষতা অৎসি তেয়াং পৃক্ষেণ যন্মবন আমান-আক্ষতি চলছে, তুমি এসো। আমাদের ধারণা, ইন্দ্র কিংবা অগ্নি বেদের খুব অবান দেবতা বলেই গরুর চেয়ে যাঁড়ের মাংস বেশি পছন্দ করতেন অগ্নির একটা বিশেষণই হল–উস্কান্ন–উচ্চ মানে বাচ্চা ষাঁড় ষাঁড়ের গড় মাংস সহ ভাত কিংবা ভাজা যবের ছাতু–উচ্চায়। আর ইন্দ্রের উদ্দেশে ঋষিরা হাঁড়ের মাসে পাক করেন এ কথা বগবেদের শব্দ মন্ত্রে বলা আছে। এবং সেটা তীব্র সোমরস সহ অমা তে তুং বৃষভা পচানি। গোমাংস খাওয়ায়। বৈদিকদের খুব একটা আপত্তি ছিল না কোনও, কিন্তু একই সঙ্গে দুগ্ধবতী গাভীকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদটা ছিল বলেই মঞ্চে গো হত্যার ক্ষেত্রে বন্ধ্যা গাভী-যার পারিভাষিক নাম ছিল ‘বসা’—সেই বসা গাভীকেই হত্যার জন্য বেছে নেওয়া হত।
আর যাঁড়ের ব্যাপারে প্রায় কোনও আপত্তিই ছিল না। সাব্বিকেরা বুঝমাংস রান্না করে দেবতাদের লোভ দেখাচ্ছেন, একথা তো আমরা খাবেদের মন্ত্রের মধ্যেই পাই। ঋষি বলছেন—হে ইন্দ্র! তোমার জন্য পুরোহিতদের নিয়ে স্থূলকায় একটি বৃহ পাক করেছি এবং পদদশা তিথির প্রত্যেক তিথিতে সোমরস বানাই তোমার জন্য। আমাদের সংরক্ষণশীল বৈদিক টীকাকারেরাও তো এইসব জায়গা এড়িয়ে যেতে পারেননি। সায়নাচার্যের মতো পণ্ডিত টীকাকাকেও এখানে লিখতে হয়েছে যে, ব্রাহ্মাণ এখানে বৃষ হত্যা করে আহুতি নিচ্ছেন। কোন দেবতার উদ্দেশে বৃষ-শরীরের কোন অংশ নিবেদন করা হবে, সে সব নিয়ে বিচেনা আছে এই মন্ত্রে। সত্যি বলতে কী, মানুষ কিন্তু সেই সব প্রিয় বস্তুই দেবতার উদ্দেশ্যে আন্ততি কিংবা ভাগে নিবেদন করে, যা সে নিজে পছন্দ করে যায়। বৈদিক মীমাংসায় যাকি পুরোহিতদের ব্যক্তিত্ব এবং প্রাধান্যের নিরিখে জ্ঞাবশেষ পশুর কোন ভাগ কে পাবেন, তারও নির্দেশ আছে। কাজেই বুধ কিংবা বন্ধ্যা গাড়ী জ্ঞাবশেষ ব্রাহ্মণেরা যদি স্বাদুভাবে খেয়ে থাকেন তো গোটা সমাজেই সেটা চালু থাকার কথা ছিল। তার মধ্যে গোম’ অর্থাৎ গরু যার জন্য কাটা হ্যা এমন একটা বহুব্রীহি সমাসে শব্দটা যদি অতিথি মানুষকেই বোঝায় তা হলে গরু যে কাটছে তাঁর আক্ষরিক গুরুত্বটুকুই নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ গরু যিনি কাটছেন সেই গৃহস্থ গোহত্যাকারী নন, অতিথির জন্য গরু কাটা হচ্ছে বলে অতিথির অন্য নামই ‘গোয়’। যাজিক ব্রাহ্মণদের দিন শেষ হয়েছে বহুকাল। ভারতবর্ষে বৈদিক দেবতা ইন্দ্র-যম, অগ্নি-বরুণের দাপট কেটে যাবার পর উপনিষদের কালেও উচ্চান্ন ষাঁড়-ভাত বা গোমাংসের খাদ্যপাত্র চালু ছিল। কিন্তু পৌরাণিক কালে যখন আমাদের দেশে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিমূর্তি এসে গেলেন উপাস্য দেবতা হিসেবে, ততদিনে যজ্ঞে আর গোবধ চলেনি। গরুর চেয়ে গন্য ততদিনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।
Khub bhalo informative pata hoyeche