Last Updated on May 29, 2022 11:33 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। খানিক ফেমিনিন চরিত্রের এক পেশাদার খুনি ,পরোপকারী এক প্রাইম সাসপেক্ট ও হার্ডকোর অথচ মানবিক এক গোয়েন্দা- এই ত্রিভুজে দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দম শীলের (Arindam Sil) তৃতীয় শবর ছবিটি। আগের দুটো শবর ছবির মত এই ছবিতে দুর্দান্ত একশন নেই,অনুপস্থিন দুদে গোয়েন্দার অলি গলিতে চেজিং, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ আর শান্ত এই থ্রিলার। অথচ কোথাও জমে যাওয়ার প্রবণতা নেই। চিত্রনাট্যের দারুন বুনোট,গল্পের নমনীয়তা, অয়ন শীলের ক্যামেরার গতিময়তা, অরিন্দমের মুন্সিয়ানা আর সর্বপরি অভিনয়ের মাধুর্যে এ ছবি গতিশীল ও গভীর। অবশ্যই অরিন্দমের সেরা শবর। প্রযোজক ক্যামেলিয়ার একটা দারুন সিদ্ধান্ত এই শবর ফ্যাঞ্চাইজি গ্রহণ করা। শুধু ক্রাইম থ্রিলার নয়,পরিচালক এক মোক্ষম প্রশ্ন তুলে দেন তার ছবিতে।
জেতা-হারা-অপরাধ-অপরাধী এসবের সংজ্ঞা আসলে কী? ছবির শেষদিকটা কেমন ঘোরের মতো মনে হয়। সাদা-কালোর বাইরে যে দুনিয়াটা আছে, তাকেই খুঁজেছেন অরিন্দম। অবশ্যই এটা তার সেরা শবর।
চেজিং সিকোয়েন্স ছাড়াও একটা থ্রিলার টানটান, অহেতুক গান ফাইট ছাড়াও বেহালার ছর টানার মত গতিশীল। এ ছবিতে শবরের রংবাজি আছে। নন্দর অসম্ভব পেশাদার যুগলবন্দী আছে।বুলুদার রহস্যময় জীবন আছে। রুমকির চোরাবালি স্বপ্ন আছে। তাই কখনও মনে হয়, ছবি যতটাই শবরের, ততটাই বুলুদার, ততটাই রুমকির ততটাই পরেশনাথের। সবার জুতোয় পা গলালেই মনে হবে এটা আসলে তার-ই গল্প। আসলে এটা এই সমাজের গল্প।

শীর্ষেন্দুর অপ্রকাশিত গল্প এই তীরন্দাজ। অরিন্দম তাঁর তৃতীয় শবরের জন্য সঠিক গল্প বেছেছেন। কিরিটি,সোনাদা,একেন আর অনলাইন ফ্ল্যাটফর্মের অসংখ্য ক্রাইম থ্রিলারের ভিড়ে শবরকে ছেঁকে আলাদা করতে পেরেছেন। দুর্দান্ত গল্প, দারুন টাইট চিত্রনাট্য আর অভিনয়,শবরকে আলাদা করে দেয়।
ট্যাক্সি চালক সুমিতকে (নাইজেল)ভবানীপুর থানায় জেরা থেকে রহস্যে শবরের প্রবেশ। তার ট্যাক্সিতে সজ্ঞাহীন যাত্রী ব্যবসায়ী সীতানাথকে(অরিন্দম শীল) নিয়ে সে থানায় আসে। দেখা যায় সীতানাথ খুন হয়েছে। সুমিতের বয়ান অনুযায়ী,ঝড় বৃষ্টির রাতে সিথি থেকে এক মহিলা ও পুরুষ সঙ্গী সহ সীতানাথকে ট্যাক্সিতে তুলেছিল বস্তির রবিনহুড বলে পরিচিত সুমিত ওরফে বুলু।
গল্পের,রহস্যের বুনোটে তিন চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যা দর্শককে ভাবায়। কপালে ভাঁজ ফেলে শবর দাসগুপ্তর।
ক) সুমিত কি সত্যি বলছে? মানুষটার অদ্ভুত জীবন,আচরণ ভাবায় শবরকে আমাদের। অর্থনীতিতে এমএসসি করা সুমিত,যে ভাগ্যের পরিহাসে সম্পত্তি হারিয়ে বস্তিতে থাকে, মানুষের উপকার করে বেড়ায় আর ট্যাক্সি চালায়। তার গাড়ি চড়েই অপরাধীর দল সোনারপুর আসে রাতের আঁধারে, যখন লুটপাটে ব্যস্ত ডাকাতরা তখন সে গাড়িতে বসে নিশ্চিন্তে এস্থার ডুফলো আর অভিজিৎ বিনায়ক বন্ধ্যপাধ্যায়ের পুওর ইকোনমি পড়ে, এলাকায় ফ্ল্যাট কেনা ব্যাবসায়ীর ওপর চাঁদার জুলুম আটকায়, এ কি মসিহা নাকি মুখোশের আড়ালে এক ধুরন্ধর খুনি? শবরের মত আমিও দ্বিধায়। গোয়েন্দাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ নিতে পিছপা হয় না।
খ) কে এই সীতানাথ? ক’বছর আগেও যে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ছা পোষা কেরানি ছিল,আজ অভিজাত ব্যবসায়ী। কোটি টাকার আয়রন কাস্টিং এর ব্যবসা।একাধিক গাড়ি থাকা সত্ত্বেও কেন সে ট্যাক্সি করে ফিরবে? তার জীবনের অতীত কি? তার স্ত্রীর সঙ্গে কেন ও কি নিয়ে মনমালিন্য? আদপে সেও কি অপরাধী,বা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত? এই প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়াবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
গ) পরেশনাথ চক্রবর্তী (চন্দন সেন)মেয়েলি গলার স্বর, দারুন নম্র এই মানুষটা আর চারপাচটা ছা পোষা মানুষের মতোই,স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সংসার করেছে। অথচ সীতানাথের ঘনিষ্ঠ এই নিরীহ মানুষটির প্রতিটি রহস্যজনক মৃত্যুর সময় উপস্থিতি ভাবায়।
ছবি যত এগিয়েছে রহস্যের গভীরতা বেড়েছে। রুমকি,দিয়ার মত চরিত্ররা ছায়ার মত সেই রহস্যকে আরও চিন্তাশীল করে তোলে।
চলচিত্র সমালোচক হিসাবে এই ছবির গল্প অবিবেচকের মত লিখে দিয়ে চলচিত্রকে ছুরিকাঘাত করব না। দর্শক যাঁরা ভালো ছবি দেখতে ভালোবাসেন,ভাবতে ভালোবাসেন অবশ্যই এই ছবি আপনাদের তৃপ্ত করবে।
শবর চরিত্রকে একধাপ উপরে পৌঁছে দিয়েছেন শাশ্বত। তিনি এই চলচিত্রের একমাত্র ট্রাম্পকার্ড। গোটা ছবি জুড়ে ছেয়ে আছেন।ঘুষি,লাথি,ফায়ার,
চেজিং ছাড়াই টপ রংবাজি। শান্ত,ধীর অনেকটা রামগোপালের কোম্পানি ছবিতে আইপিএস শ্রীনিবাসের চরিত্রে মালায়লাম তারকা মোহনলালের কথা মনে পরিয়ে দেয়।যে শান্তভাবে পোস্টমর্টেম করে ফেলেছিল কোম্পানির।শবরের চরিত্রে শাশ্বত সেই কাজটাই করলেন। প্রতি দৃশ্যে অনবদ্য।অভিনয়ে তাঁকে নম্বর দেওয়া অসম্মান করা। পাশে নন্দর চরিত্রে শুভ্রজিৎ এককথায় দুর্দান্ত। একটু ডাউন হয়েও অসম্ভব ভালো টাইমিং। ওর হিউমার সংলাপ ছিল মেদহীন, স্বতঃস্ফূর্ত। বাংলার পরিচালকদের ওকে বেশি করে ব্যবহার করা উচিত।
শেষে চন্দন সেনের কথা বলতেই হয়। অতি অল্প পরিসরে ড্রিবল করা যাকে বলে। দাপটের সঙ্গে আলো অন্ধকারের চরিত্রটাকে দুর্দান্ত চেহারায় পৌঁছে দিলেন।
ক্যামেলিয়া প্রযোজনা সাহসের সঙ্গে এই ছবি প্রযোজনা করেছে। প্রযোজক রূপা দত্তকে ধন্যবাদ এই কারণে যে, যে হারে বাংলা ছবিতে আতলামো বাড়ছে, বৃদ্ধাশ্রম থেকে পথের পাঁচালির রিমেক,তাতে অচিরেই দর্শকশূন্য হয়ে যেতে পারে বাংলা চলচ্চিত্র। অন্তত মেইন স্ট্রিম ছবি বানানোর পাশে থেকেছেন আপনারা।