Last Updated on November 20, 2020 8:56 PM by Khabar365Din
সন্দীপ রায়ের বােম্বাই-এর বােম্বেটে দেখার পর আমি নতুন ফেলুদা’র আবির্ভাব ও সিনেমার বিস্তার নিয়ে বিষয়ে লিখতে সম্মত হয়েছিতার কারণ ৪৫ বছর এই পেশায় থাকার ফলে নিজের ব্যক্তিগত মতামত সাধারণ্যে হাজির করার কিছুটা অভ্যাস তৈরি হয়, অতকিছু মনের বাধা তৈরি হয় না। যদি এ ছবিতে আমি নিজে অভিনয় করতাম তাহলে অবশ্যই লেখার কথা ভাবতেই পারতাম না। তেমনি আবার সত্যজিৎ রায়ের করা ফেলু সিরিজের দুটি ছবিতে অভিনয় করার এতদিন পরে নব পর্যায়ে বড়াে পর্দার জন্যে যখন ফেলু কাহিনি নিয়ে ছবি তৈরি হল তখন তা দেখার কৌতুহল যেমন হল, তেমনি দেখে মনের যে প্রতিক্রিয়া হল তা দর্শক তথা পাঠকের কাছে জানাবার একটা তাগিদ যেন মনের মধ্যে ধাক্কা দিতে লাগল। সেই কারণেই বোেম্বাই-এর বােম্বেটে সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াকে লিপিবন্দী করার জন্যে রাজি হয়েছি। সন্দীপের করা প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি ফটিকাদ দেখেই মনে হয়েছিল সিনেমা বানানাের কারিগর হিসেবে সে দুর্দান্ত। গুপী বাঘা ফিরে এল দেখেছি তার। সেখানেও ক্রাফটসম্যানশিপের অসামান্য পরিচয় পেয়েছি। সত্যজিতের সব শেষের মৌলি চিত্রনাট্য উত্তরণ;যা তিনি নিজে চলচ্চিত্রায়িত করতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পরে সন্দীপ সেই দায়িত্ব পালন করে, সে ছবিতে আমি অভিনয়ও করেছিলাম। অভিনয় করার সময় পরিচালক রূপে, সিনেমা নির্মাতা হিসাবে তার যে পরিচয় পেয়েছিলাম। সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন গল্প ও গােয়েন্দা ফেলুর কাহিনি নিয়ে তার আগে ও পরে বেশ কিছু টেলিফিল্ম সে তৈরি করেছে। বােম্বাই-এর বােম্বেটে-তে সন্দীপ বড় পর্দার সেই সুযােগকে পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করেছে। বােম্বাই-এর বােম্বেটে ছবির ভিশুয়াল প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শককে একটা টানটান রহস্যকাহিনির জন্যে প্রস্তুত করে নেয়। তারপর কাহিনি যখন কলকাতা থেকে মুম্বাইতে যায় তখন বিমানবন্দর থেকেই এই দৃশ্যগত আকর্ষণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। শহর মুম্বাইয়ের পথঘাট সমুদ্রতীর মাল্টিস্টোরিড এমনকী তার লিফট-এর কুয়াে, সব কিছুকে যেন জীবন্ত বন্দী করে ক্যামেরা। পরিবেশকে ধরার ব্যাপারে চমৎকার ফোটোগ্রাফির সহযােগী হয় সুনির্বাচিত শব্দের বিন্যাস। অবশ্য বলাই বাহুল্য ক্যামেরা ও শব্দের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ তৈরি করা এবং গল্প বলার কাজটার মূল কৃতিত্ব পিরচালককেই দিতে হবে।

শট-এর জন্যে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল নির্বাচন, ক্যামেরার মুভমেন্ট পরিকল্পনা করা, শট-এর ডিউরেশন স্থির করা, এই কাজগুলাের মধ্যে দিয়ে এক অমােঘ ক্লাইম্যাক্সের দিকে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান পরিচালক। সেইসঙ্গে লােকপরিকল্পনা ও শব্দের পরিকল্পনাকে এমন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন পরিচালক ৭. অন্তদৃশ্য ও বহিদৃশ্য সম্পূর্ণ মিশে গিয়ে বাস্তবতার মায়াবরণকে চূড়ান্ত করে তােলে। এই ছবিতে এত বেশি লােকেশন এত অন্তদৃশ্য আছে যে তার শুটিং করাটাই বেশ শক্ত কাজ। তার মধ্যে সবরকম কনটিনিউটি বজায় রেখে এই আ মায়া আবরণ তৈরি করাটা সত্যিই পরিচালকের মুনশিয়ানাকেই প্রমাণ করে। মুম্বাই-এর আর. কে. স্টুডিওতে যেখানে স্টান্টমেন ও ফাইটাররা বিতা করছেন সেই দৃশ্যে যতদূর মনে পড়ছে ফেলুর খানিকটা ক্যারাটে দক্ষতা দেখানাে ছিল মূল উপন্যাসেই। সিনেমাতে সেই দৃশ্যটি ছবির শেষ সিকোয়েন্সের রােমহর্ষক উত্তেজনার শুধু যে একটা পূর্বাভাস তৈরি করে তাইনয়, ফেলু চরিত্রের একটা। আধুনিকীকরণও ঘটে যায় এইখানে। আজকের নবতরুণ যারা অজস্র হিন্দি বাংলা। ছবির ফাইটিং সিন দেখতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে ফেলুর নায়কোচিত সংঘর্ষ ক্ষমতার। একটা সূত্রপাত হয় এইখানে। পরে এই গুণের আরও পরিচয় পাওয়ার আগে এটার। দরকার ছিল।
উপন্যাসে শেষ ক্লাইম্যাক্স যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তার চিত্ররূপায়ণ অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই শেষ অংশে ট্রেন, ঘােড়া ও শুটিং-রত মােটরগাড়িগুলি এবং কয়েকশত অভিনয়কর্মী নিয়ে ছবিতে যে ক্লাইম্যাক্স রচনা করা হয়েছে তার তুলনা বাংলা সিনেমায় দেখেছি। বলে মনে পড়ে না। এই ছবিতেই পরিহাসছলে উল্লেখিত শশালে ছবির তুলনাই এখানে মনে পড়ে। অভিনয় সম্পর্কে কোনাে কিছু বলতে গেলে, প্রথমেই সব্যসাচীর কথা বলতে হয়। এর আগে বাক্স রহস্য দেখেই তার অভিনয় আমার ভালাে লেগেছিল। এ ছাক্ষ্ম তার কাজের মধ্যে আরও খানিকটা সূক্ষ্মতার দেখা পেলাম। প্রখর বুদ্ধির সঙ্গে রসবােধ ও মানুষসুলভ আবেগগুলাে সে আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারল, তার সুন্দর গলার আওয়াজ ও বুদ্ধিমান উপস্থিতি ফেলু চরিত্রকে চমৎকারভাবে প্রতিষ্ঠা করে পরমব্রতর তােপূসেকেও ভালাে লাগল। তার চেহারায় ছেলেমানুষি সরলতা ও বুদ্ধিমত্তার ভারি সুন্দর একটা মিশেল হয়েছে।
যে ধরনের জমজমাট ছবি সন্দীপ বাঙালি দর্শককে উপহার দিল তার জন্যে সে ধন্যবাদাহ। মধ্যবিত্ত প্রেম-বিয়ে বা অবক্ষয়ের ঘ্যানঘ্যানানি ও বাংলা সংলাপে হিন্দির জেরক্স থেকে এই ধরনের ছবি মুক্তির পথ বলে দিচ্ছে। সুস্থ ও বুদ্ধিদীপ্ত ছবির জন্য চাহিদা তৈরি হােক এমন ছবি দেখে। সান্যাল আর গােরে যে একই নােক এটা উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছিল শেষে। ছবিতে গােড়াতেই সেটা দর্শককে জানিয়ে দেওয়াতে সাসপেন্স আরও জমাট বাঁধে প্রথম থেকেই। এটা পরিচালক চিত্রনাট্যকারের মুনশিয়ানা। কিন্তু সেই অবস্থাটা কাজে। লাগিয়ে চরিত্রটাকে আগাগােড়া আকর্ষণীয় করে রাখাটা নিশ্চয়ই আশীষ বিদ্যার্থীর অভিনয়দক্ষতার স্বাক্ষর। রজতাভের নিম্মাে শুধু চেহারাতেই নয় চরিত্রের নির্মম পেশাদার কিলার হিসেবে একটু যেন অপূর্ণ। আর একটু বেমানান লাগে রাজেশ শর্মাকে পেরুমল হিসেবে। তার দক্ষিণী হিন্দি বলাটা আর একটু প্রতিষ্ঠা করার দরকার ছিল। এবং তার স্ফীততােদরের একটুও দরকার ছিল না। ক্যারাটে কুঙফু করার সময় তার লাথিগুলােতে অ্যাথলিট সুলভ দার্চ ও ক্ষিপ্রতার একটু যেন অভাব ছিল। তবে মন ভরিয়ে দিয়েছে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলক।