Last Updated on April 7, 2022 10:01 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। সৌগত সরকার। বাংলা চলচিত্র জগৎ তাঁকে উত্তমকুমার পরবর্তী মহানায়কের আসনে বসিয়েছে, শুধু বিগত ৪০ বছর ধরে ব্যাংলা চলচিত্রকে শাসন করার জন্য নয়, সাড়ে তিনশোরও বেশি ছবি, একাধিক জাতীয় পুরস্কার, ডজন খানেক সম্মানের জন্য নয়। আরও বড় ব্যাপ্তির জন্য তিনি বাংলা চলচিত্রের মহানায়ককে মর্যাদা আদায় করেছেন।
১৯৮০ থেকে ২০২১ তাঁর দীর্ঘ এই যাত্রায় তিনবার গুরুত্বপূর্ণ বদল এনেছেন। যার প্রতিটা পর্যায় ব্যাংলা চলচিত্র এবং বাংলা চলচিত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বাঁচার, এগিয়ে চলার ইন্ধন জুগিয়ে গিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিকে এই জ্বালানিটা তিনি নিরন্তর জুগিয়ে গিয়েছেন। অভিভাবকের মত হাত ধরে রাস্তা পার করছেন। মহানায়কোচিত এই অধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য অতিতে কেউ করেছে বলে মনে পড়ে না।
হৃষিকেশ মুখার্জির ছোট্ট জিজ্ঞাসা,
ছবির কথা বলছি না, কারণ তিনি ছিলেন শিশু শিল্পী মাত্র।১৯৮০ তে পীযুষ বসুর দুটি পাতা দিয়ে যাত্রা শুরু। সবে প্রয়াত হয়েছেন উত্তমকুমার।সৌমিত্র,শুভেন্দুরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে। চরম শূন্যতায় তরুণ মজুমদারের হাত ধরে দাদার কীর্তি করে ফেলেছেন। পরপর সাহেব, ভালোবাসা ভালোবাসা হিট। সুখেন দাস, সুজিত গুহ কিংবা অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে প্রসেনজিৎ (Prosenjit Chatterjee) তখন লড়াই করছেন। প্রতিশোধ, জীবন মরণ, দাদামনি, শত্রু ছবিতে তাঁর কাজ দর্শকদের পছন্দ হল। ১৯৮৬ র পর থেকে বাজি ঘুরতে শুরু করল। ১৯৮৭ গুরুদক্ষিণায় বড় হিট পেলেন তাপস। কিন্তু প্রসেনজিৎ তাঁর ননস্টপ পারফরম্যান্স দিয়ে চললেন ধারাবাহিক ভাবে। ১৯৮৬ থেকে ৯০ র মধ্যে অন্তত ৭০ টা ছবি, যা ইন্ডাস্ট্রিকে, এর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বাঁচিযে রাখল। হিন্দি ছবিতে তখন অনিল কাপুর, সঞ্জয় দত্ত,শাহরুখ, আমির, সলমন, গোবিন্দাদের ঝড় উঠেছে। বাংলা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। পুরানোরা তখনও স্বর্ণ যুগের ঘি চেটে চলেছেন। আহা কি ছবি ছিল আমাদের সময়ে! কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে চলেছিলেন প্রসেনজিৎ। সঙ্গে তাপস ও চিরঞ্জিত। পথভোলা, প্রেমবন্ধন, সম্রাট ও সুন্দরীর পর অমর প্রেম। ঘুরে গেল ইন্ডাস্ট্রির অভিমুখ। আমার তুমি, মনে মনে, আপন আমার আপন সব সব ছবি সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় হাজার সিঙ্গল স্ক্রিন দাপিয়ে বেড়ালো। হিন্দি ছবির তুফান কিছুটা হলেও আটকে গেল বাংলায় এসে।

ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখলেন
দক্ষিণ নয়, অভিমুখ বাংলা
নয়ের দশকে এসে এই অভিমুখ পুরোটাই ঘুরিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ। কথা দিলাম, এক পশলা বৃষ্টি, আপন পর, শয়তান, অধিকার, পুরুষোত্তম, মন মনে না, তুমি যে আমার, ধূসর গোধূলি হিন্দির সঙ্গে লড়াইটা সমানে সমানে করে দিল। এই দশকে অন্তত ১০০ ছবি খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিল।
শুধুমাত্র ঋতুপর্ণার সঙ্গেই প্রায় ৪৪ টা ছবি, যার ৯৩ শতাংশ হিট।
সুজিত গুহর অমর প্রেম থেকে হরনাথের সংঘর্ষ, শচীন অধিকারীর শেষ প্রতীক্ষা, স্বপন সাহার মায়ার বাঁধন, সখী তুমি কার, বাবা কেন চাকর,রাজকুমার, চাওয়া পাওয়া, প্রভাত রায়ের লাঠি, খেলাঘর, অনুপ সেনগুপ্তর সবুজ সাথী,ঘর জামাই, ইনক্লাবের মত ছবির টিকিট ব্ল্যাক হয়েছে তার সাক্ষী এই প্রতিবেদক নিজে। কর্পোরেট চাকরির সুবাদে বাংলার বিভিন্ন জেলায় আমি সেই দৃশ্য দেখেছি। শুধু ঋতুপর্ণা নয়, প্রসেনজিতের সঙ্গে রচনার জুটি ছিল গ্রামবাংলার সুপারহিট জুটি। সবুজ সাথী, স্নেহের প্রতিদান, কুরুক্ষেত্র, মায়ের আঁচল, স্নেহের প্রতিদান,
বাজি, গ্যাঁড়াকল’, একাই একশো,
অন্যায় অত্যচার, শত্রুর মোকাবিলা, মতো ৩৫টি ছবিতে জুটি বেঁধে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছে প্রসেনজিৎ-রচনা জুটি যার বেশিরভাগ ছবিই বক্স অফিসে সুপারডুপার হিট। ছবি মুক্তির আগে ভ্যান রিকশায় কাঠের বাটামে প্রসেনজিৎ রচনার ছবির পোস্টার লাগিয়ে কৃষ্ণনগর,মালদার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইক ফুঁকতে দেখেছি। ওই ভ্যান থেকেই টিকিট বিক্রি হচ্ছে। বাচ্চা, বুড়ো লাইন দিয়ে মারামারি করে টিকিট কিনছে।

পরিবর্তনের সময়
এবার দরকার ছিল পরিবর্তনের। হিন্দি সহ গোটা বিশ্বে বিনোদনের ভাষা দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। প্রসেনজিৎ হলেন সেই প্রথম সফল সুপারস্টার যিনি ইন্ডাস্ট্রিতে সবার আগে বুঝেছিলেন, হিরোইজমের ভাষা বদলাচ্ছে দ্রুত। ছবিতে বিষয় বা কন্টেন্ট গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ঋতুপর্ণ এলেন নতুন ছবির ভাষা নিয়ে। উনিশে এপ্রিল সেই পরিবর্তনের প্রথম সফল ধাপ। একই সঙ্গে তখন প্রসেনজিৎকে কঠিন সিধান্ত নিতে হত। একদিকে অন্যধারার সিনেমা অন্যদিকে চিরাচরিত বাণিজ্যিক মশলা ছবি। কোনটা বাঁছবেন তিনি? তিনি নিজেই সিধান্ত নিলেন। একই সঙ্গে অন্য ধারার ছবির রিস্ক নেবেন, পাশাপাশি ব্যাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নিজের চোখে দেখা, যখন উনিশে এপ্রিল চলছে প্রিয়াতে আর বসুশ্রীতে চলেছে প্রভাত রায়ের লাঠি। দুটোই হিট। দর্শককে দু ভাগে ভেঙে দিতে সক্ষম হলেন প্রসেনজিৎ। একদিকে স্বপন সাহা, সুজিত গুহ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যয়ের হিট ছবি অন্যদিকে হরনাথ, প্রভাত রায়, ঋতুপর্ণর ভিন্ন স্বাদের ছবি।
শূন্য দশকে এসে চিত্রটা পাল্টে গেল। ব্যাংলা ইন্ডাস্ট্রি আবার নিজের মত করে জ্বালানি সংগ্রহ করে নিয়েছে।

গভীর উপলদ্ধি
প্রসেনজিৎ নিজেকে আরও ভাঙতে শুরু করলেন। ঋতুপর্ণর উৎসব সেই ভাঙার শুরু। এতদিন এই পরিবর্তন ছিল ম্যাক্রো লেভেলে। অর্থাৎ ছবির কন্টেন্ট ও চরিত্রের ভিন্নতা। এবার অভিনয়ের মূল জায়গাটা তিনি পরিবর্তন করতে শুরু করলেন।
ডাউন দা লাইন অভিনয়। নিচু তারে বাধা অভিনয়। দোসর, সব চরিত্র কাল্পনিক, হরনাথ এর রিফিউজি, চল পাল্টাই,বুদ্ধদেব দাসগুপ্তর স্বপ্নের দিন, পাশাপাশি রবি কিনাগি, সুজিত গুহদের সঙ্গেও চলছিল কাজ।
এর পরে এল বড় ধাক্কা। সাড়ে তিন মাস মাটিতে শুয়ে, নিরামিষ খেয়ে, বাউল সংগ করে নিজেকে অভিনেতার পরিপূর্ণতার দিকে নিঃশব্দে নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রসেনজিৎ। মুক্তি পেল গৌতম ঘোষের মনের মানুষ। ইন্ডাস্ট্রি বুঝে গেল মহানায়ক থেকে মহা অভিনেতা হয়ে ওঠার নতুন যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। সৃজিত মুখার্জির প্রথম ছবি অটোগ্রাফ, ঋতুপর্ণর নৌকাডুবি, চোখের বালি, কেবল জাতীয় পুরস্কার নয়, বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন দিক উন্মোচন করে দিলেন প্রসেনজিৎ। বাইশে শ্রাবণ থেকে জাতিশ্বর, গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল থেকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের কিশোর কুমার জুনিয়র, জেষ্ঠপুত্র থেকে গুমনামি এই যাত্রা ও অবলীলায় গ্রাম ও শহর দুই দর্শককুলকে এক ছাতার তলে নিয়ে এসেছে। হয়ত সময় লেগেছে ২০ বছর। কিন্তু বাংলা চলচিত্রকে একা তিনিই নতুন সিনেমার ইন্ধন জুগিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে গ্রাম বাংলার পোসেনজিত কিন্তু আল্টিমেটলি সব দর্শককে স্ট্রিম লাইনে এনে ফেলেছেন। আজ ক্ষত কিংবা ময়ূরাক্ষীর মত ছবি গ্রাম বাংলাতেও মুক্তি পেতে ভয় পায় না। কারণ প্রসেনজিৎ এই ৩৫ বছরে সাগরকে (অমর প্রেম) কুশল হাজরাতে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।