Last Updated on October 13, 2021 7:42 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। সৌগত সরকার। শেষ খেলার অর্ধে নগেন্দ্রপ্রসাদের কণ্ঠে বন্দেমাতরম খানিক নাটকীয়, মন্টুর চরিত্র বড্ড ছেলেমানুষ, ফুটবল আরও টেকনিক্যাল দরকার ছিল,ব্লা ব্লা ব্লা অনেক সমালোচনা হল গোলন্দাজ নিয়ে। কিন্তু এ ছবি যে ইতিহাস গড়ে দিল সে কথা মাথায় রাখলে, এসব সমালোচনা মূল্যহীন মনে হয়। এই ছবি সমালোচনার উর্ধে। দুই জোড়া কাপলের মধ্যে জোর দর কষাকষি চলছে, স্বভূমিতে বুর্জ খলিফা নাকি আইনক্সে দেবের গোলন্দাজ। চায়ের ভাঁড় হাতে কান খাড়া করে অধীর আগ্রহে রুদ্ধশ্বাস সাত মিনিট কাটল। উবের ওলা এড়িয়ে বুক মাই শো তে ক্লিক হতেই,জিতল বাংলা চলচ্চিত্র, এটাই দেবের গোলন্দাজ এর সফলতা। ৫০ শতাংশ দর্শক অনুমতি নিয়ে থমকে চলা বাংলা চলচ্চিত্র আজ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেবের হাত ধরেই, এটাই গোলন্দাজের সার্থকতা। এটাই বাংলা ছবির সবচেয়ে বড় ক্যাম্পেন। প্রিমিয়ার দেখে এসে সংবাদপত্রের জন্য নিউজ এলিমেন্ট হিসাবে গোলন্দাজ নিয়ে খবর করতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলাম, বাংলা ছবির রোনাল্ডো দেব। অনেকেই সেটা পড়ে শেষমেশ বুঝে উঠতে পারেননি,এই উপমা কি দেবের ফুটবল স্কিল নিয়ে বললাম,নাকি ছবি ফুটবল নিয়ে তাই এমন শব্দের ব্যবহার!
আসলে দুটোই।হ্যা, ভেবেই লিখেছিলাম যে দেব বাংলা ছবির রোনাল্ডো। বিশ্বাস না হয়, একবার গোলন্দাজ ছবির যে কোনও শো দেখে আসুন। কি উন্মাদনা, কি উচ্ছাস, শুধু তাঁকে ঘিরেই। কি ভীষণ পরিশ্রম আর কতটা পরিণত অভিনয় করে একার কাঁধে ছবিকে টেনে নিয়ে গেলেন দেব। প্রায় ২ ঘন্টার ছবি জুড়ে শুধুই দেব। অভিনয়,বডি ল্যাংগুয়েজ, ক্যারিশমা, সবটা জুড়ে তিনিই ছেয়ে আছেন। নিজের অভিনয়কে উত্তীর্ণ করেছেন অনেকটা ধাপ। গোটা ছবি জুড়ে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। সত্যিই তিনি যেন রোনাল্ডো। অভিব্যক্তি, চোখের চাহুনি, বুকফাটা আর্তনাদ, হতাশা, এই অভিনয়ের ছোট ছোট ড্রিবলে ফুটিয়ে তুলেছেন নগেন্দ্রপ্রসাদের চরিত্রের কাঠিন্য, যন্ত্রনা, হতাশা, বিরহ, কিংবা জেদ। প্রথম ১০ মিনিট পর থেকেই হরিণের মত চিত্রনাট্যের বক্স টু বক্স ছুটছেন, সাবলীল দৌড়ে চরিত্রের নির্যাস বের করে এনেছেন।
কুস্তির আখড়া থেকে ফুটবলের মাঠ, স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ট অনুরাগের দৃশ্য,রাগের বহিঃপ্রকাশ কিংবা বারুদ ঠাঁসা সংলাপে আসে পাশে থাকা থিয়েটার করে আসা অভিনেতাদের টপকে স্পট জাম্পে গোল করে গেলেন প্রতিটা দৃশ্যে। থিয়েটার করে আসা অভিনেতা বললাম, অনির্বানকে কথা ভেবে। ওর অভিনয়ের অনুরাগী ছিলাম। অদ্যই শেষ রজনী ২০১৬ সালে ৪ বার দেখেছি। সত্যি বলছি, এই ছবিতে অনির্বানকে প্রতি মুখোমুখি দৃশ্যে ছাপিয়ে গিয়েছেন দেব। বিভিন্ন ছদ্মবেশে ভার্গবের আসা এবং নগেনদাকে উৎসাহিত করার মধ্যে মজা নেই, বরং শেষদিকে এক্সপেক্টেড হয়ে যাচ্ছিল। যার মধ্যে এত বারুদ, যিনি একার আগুনে ইংরেজ আভিজাত্যকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছেন,জীবন মৃত্যুর পরোয়া না করে শুধু জাত্যাভিমান আর আদর্শের জন্য যিনি সর্বস্ব পন করেছেন, তাঁকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ভার্গবের দরকার পড়েনা। অন্তত তিনটি দৃশ্য দেবকে এই মুহূর্তে বাংলা ছবির অন্যতম সেরা অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। শোবার ঘরে স্ত্রীর কাছে সহজ স্বীকারোক্তির দৃশ্য, বন্ধু ও সহকর্মী মন্টুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসার দৃশ্য এবং ওয়েলিংটন ক্লাব ভেঙে ফেলার দৃশ্য। গোটা ছবিতে অন্তত ৭ টি দৃশ্যে দেব আন্ডার এক্টিং করেছেন, বিলো দা লাইন। শান্ত, ধীর, খুব স্মিত। দুর্দান্ত, কেয়া বাত।

ছবিতে দ্বিতীয় যে অভিনেতার কথা না বললেই নয়, তিনি আলেক্স ও নিল। মেজর ফ্রেডরিক জ্যাকসনের ভূমিকায় তিনি লা জবাব। অভিজ্ঞ এই ব্রিটিশ অভিনেতা দীর্ঘদিন হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এত বড় চরিত্রে অভিনয়ে তিনি অভিনেতা হিসেবে নিজেকে চিনিয়েছেন। রীতিমত রাগ হচ্ছিল মেজর জ্যাকসনের ওপর, এটাই ওর অভিনয়ের সার্থকতা। একই সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা বড় ল্যাপ প্রযোজক হিসাবে টপকে গেল এসভিএফ। ক্রীড়া নিয়ে বাংলায় এমন ছবিও বানানো সম্ভব, যেখানে ছবির ৯০ শতাংশ জুড়ে শুধুই ফুটবল, অথচ তা টানটান তাঁরে বাধা,এটা করে দেখাল এসভিএফ। এই ছবিকে সমালোচনা না করে বরং স্মৃতি থেকে বাংলা ও বাঙালির ফুটবলের হারিয়ে ঐতিহাসিক অধ্যায়কে পর্দায় ফিরে পাওয়ার জন্য উদযাপন করা উচিত। পরিচালক এমন এক চরিত্রকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, যিনি ভারতীয় ফুটবলের জনক, বাঙালির ফুটবলের অভিধান যাঁকে দিয়ে শুরু হওয়া উচিত ছিল, অথচ তাঁর নামে কোনও স্ট্যাচু নেই ময়দানে, গ্যালারিতে নেই স্ট্যান্ড, এই লজ্জা নিয়ে ছবিটা দেখেতে বসতে হবে আমার মত অনেককেই। খালি পায়ে,গোরাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফুটবলের লড়াইটা আসলে জাত্যাভিমানের সংগ্রাম। তবুও এই ছবিকে নগেন্দ্রপ্রসাদের বায়োপিক বলতে আপত্তি আছে।আবেগ, আড্রিনালিন ক্ষরণ, দেশাত্ববোধ, নাটকীয়তা সব এলিমেন্ট ছবি জুড়ে থাকলেও ফুটবল ফোকাস থেকে এক চুলও নড়েনি ধ্রুব। তাই তো শেষ দৃশ্যে ডান পায়ের ড্রিবলিংয়ে দুই ইংরেজকে ছিটকে দিয়ে জালে বল জড়িয়ে নগেন্দ্রপ্রসাদের উচ্ছাসের সঙ্গে হল ভর্তি দর্শকের চিৎকার, এ যেন বাংলার ফুটবলের জয়ধ্বনি। আবার বলছি, হিন্দি ছবি লাগানের সঙ্গে তুলনা করতে যাবেন না, ছবি দেখুন, উদযাপন করুন ভারতীয় তথা বাংলার ফুটবলের সবচেয়ে ওথেন্টিক এই ছবিকে।