Last Updated on November 7, 2023 1:09 AM by Khabar365Din
বাংলাদেশ থেকে ফিরে গৌতম লাহিড়ী
৩৬৫দিন। আসন্ন জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ তীব্র হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অগ্নিরীক্ষা। হিন্দুদের জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজা নির্বিঘ্নে পালিত হয় কিনা। পঞ্চমীর দিন থেকেই ঢাকা থেকে খুলনা-পাবনা- চট্টগ্রামের এবং প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার প্রান্তে উৎসবের মেজাজ এপার বাংলার মতোই মাতোয়ারা। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। হিন্দুদের সংখ্যা দেশভাগের থেকে হ্রাস পেলেও বেসরকারি মতে দশ শতাংশের কাছাকাছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর হত্যার পর সামাজিক চিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। জাতিসত্ত্বার আইডেনটিটির থেকে ধর্মীয় পরিচয় প্রাধান্য পাচিছল । তাই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবের মেজাজ অনেক সময়েই ম্লান হয়েছে। নানাবিধ হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিবেদন অহরহ প্রতিফলিত হয়েছে ভারতের গণমাধ্যমে।
এবার দুর্গাপুজার ব্যতিক্রমী উৎসব পালন নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ছবি দেখলাম পুজোর কয়েকদিন। উৎসবর প্রাঙ্গণে মুসলিম সমাজের উপস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই দুর্গাপুজা ধর্মীয় উৎসবের তুলনায় সর্বজনীন প্রমাণিত করলো। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিম নেতাদের মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করেছেন। তাঁরা চন্দনের তিলক কপালে সাগ্রহে পরেছেন। এ চিত্র উত্তর ভারতের হিন্দু বলয়ে বিরল। পঞ্চমীর দিনে দিল্লি থেকে ঢাকা। পরিকল্পনা মতো ঢাকা থেকে খুলনা সড়ক পথে । দুরত্ব ১৩২ কিমি। একসময়ে ঢাকা থেকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার খুলনা পৌঁছাতে সময় লাগতো প্রায় আট ঘন্টা। খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপর নবনির্মিত ৬.১৫ কিনি দীর্ঘ রেল-সড়ক সেতুর দৌলতে একটানা মোটরগাড়িতে সফর করলে চার ঘন্টার কম সময়ে পৌঁছানো যায়। উদ্দেশ্য ছিল সড়ক পথে যাওয়ার সময়ে দুর্গাপুজোর মন্ডপ দেখতে দেখতে যাওয়া।
ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মধ্য ঢাকার ফার্ম গেট পর্যন্ত ১১.৫ কিমি দীর্ঘ উড়াল এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাত্র দশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়। অক্টোবর মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উড়ালপথের উদ্বোধন করেন। এই পথটুকু পৌঁছাতে কিছুদিন আগেও ঘন্টা দুয়েক লেগেছে। ঢাকার প্রবাদপ্রতিম ট্রাফিক জ্যামের কারণে। তবে শহরের মধ্যে সমস্যা এখনও রয়েছে। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁওতে যাওয়ার পথেই রাস্তার ধারে বিশাল তোরণ। দুর্গাপুজার। উদ্বোধক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, বাংলাদেশের সর্বত্র এবার প্রায় সকল দুর্গাপুজোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন নেতা-মন্ত্রী, রাজনৈতিক কর্মী। শাসক আওয়ামি লিগের বিশেষ নির্দেশ ছিল প্রত্যেক পুজা মন্ডপে অতন্দ্ৰ প্রহরীর মতো পাহারা দেওয়া। কিছু জায়গায় আওয়ামি বিরোধী বিএনপি নেতাদেরও দেখেছি। সতর্ক ছিলেন সকলইে। দুর্গাপুজোয় অতীতে যে হাঙ্গামা হয়েছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। এবার বাংলাদেশে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর সংখ্যা ৩২ হাজার ৪০৭। গত বছরের তুলনায় আড়াইশো বেশি। ঢাকা শহরেই কলকাতার থিম পুজোর মতো পুজা মন্ডপ সংখ্যায় ২৪৪। খুলনা শহরে প্রায় একশো। জেলায় ( এখানে উপজেলা) সংখ্যা নশোর সাছে। সবথেকে বেশি দুর্গাপুজোর সংখ্যা মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মভূমি চট্টগ্রামে। দুহাজারের বেশি। নিকটবর্তী পার্বত্য এলাকা বলে দুর্গা সেজেছে এখানে জনজাতির পোষাকে।
মধুমতী নদী পেরিয়ে দেখেছি দুধারে মন্ডপের আলোকমালার সজ্জা। খুলনা শহরের র রূপসা নদী পেরিয়ে প্রত্যন্ত প্রান্তে গ্রাম বাংলার পুজোয় কোনো ভাবেই আতিশয্য এপার বাংলার থেকে কম নয় ৷ খুলনা শহর থেকে কিছু দুরের বঙ্কিমচন্দ্রের বাগেরহাটে লিটন শিকদারের বাড়ির পুজো সর্বজনীন। একে বাংলাদেশ তথা এশিয়ার বৃহত্তম দুর্গাপুজো বলে দাবি করেন সিকদার পরিবার। প্রতিমার সংখ্যা পাঁচশো এক। মহা ভারত-রামায়ণ হিন্দু পুরাণের কাহিনি প্রতিমা বানিয়ে সাজানো। দূরদুরান্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান এই কদিন সিকদার বাড়ির পুজোর প্রসাদ খেয়ে আনন্দ করছে। উল্লেখ করার বিষয় এবার প্রত্যেক আওয়ামি লিগ নেতা পুজোমন্ডপে সামিল হয়েছেন নিজেকে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক প্রমাণে। এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার প্রতিযোগিতা । কে কত মন্ডপ উদ্বোধন করেছেন। আসন্ন নির্বাচনে দুর্গাপুজোর সাফল্য শেখ হাসিনার সংখ্যালঘু ভোট আদায়ের অন্যতম অস্ত্র। হয়তো প্রতিবেশি ভারতের মানুষের কাছেও এসব বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা দুর্গাপুজোর উৎসবকে ম্লান করতে পারেনি। এটাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিচয়। এই ভাবমূর্তি বজায় রাখার নিরন্তর সংগ্রামে বাঙালি ।