Last Updated on May 11, 2023 8:57 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। ধর্ম হল সেই আগুন যেটা জ্বালানির শক্তি দিয়ে ভারতের মত বিশাল ট্রেনের ইঞ্জিনকে টেনে নিয়ে যাবে,কিন্তু সেই আগুন অন্য কাজে ব্যবহার হলে,প্রতিটা কামরা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। বিখ্যাত এই রাজনৈতিক দর্শন প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণের আগে পণ্ডিত নেহরুকে দিয়েছিলেন মহত্মা গান্ধী। যে আগুন নিয়ে খেলা ভারতের এতদিন রুখে রেখেছে দেশের সংবিধান এবং আইন, সেই অগ্নিগোলক দুর্দান্তভাবে সংবিধান ও আইন এড়িয়ে ব্যবহার করতে সফল হয়েছে আর এস এস এবং ভাজপা। শুধু হেট স্পিচ নয়, সিনেমার মত সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য আরও শক্তিশালী মাধ্যমকে উপযুক্ত ব্যবহার করে ধর্মীয় ঘৃণার প্রচার চলছে খুল্লামখুল্লা। পৃথ্বীরাজ বা রানা প্রতাপ এর মত সফট হিন্দুত্ববাদের খোঁচা নয়,রীতিমত কাশ্মীর ফাইলস বা কেরালা স্টোরির মত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার কামান দাগা। কাশ্মীর ফাইলস দিয়ে শুরু, এখন দ্যা কেরালা স্টোরি কুৎসিত ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করার যে চিত্রনাট্য সাজিয়েছে,তা তীব্র ঘৃণার বার্তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলার মত সহনশীল ও সহিষ্ণু রাজ্যের অভিভাবক হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এই রাজ্যে এই ছবির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করেছেন। আর গোটা ভাজপা টিম ঝাঁপিয়ে পড়েছে শিল্পের কণ্ঠরোধের স্লোগান নিয়ে। পরিচালক সুদীপ্ত সেন থেকে অমিত শাহর প্রিয় পাত্র কাশ্মীর ফাইলস খ্যাত বিবেক অগ্নিহত্রি শিল্পের,শিল্পীর দমন হল বলে ময়দানে নেমে পড়েছেন। মামলাও দায়ের হয়েছে বাংলার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কি দ্বিচারিতা এই তথাকথিত শিল্পের রক্ষকদের। আজ যারা বড় বড় কথা বলছে, একদিন তারাই একের পর এক চলচিত্র নিষিদ্ধ করে এসেছে। গুজরাত,উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান সহ ভাজপার ক্ষমতায় থাকা প্রতিটি রাজ্য এই কাজ করে এসেছে। তাই এদের আসল রূপ সামনে আসা দরকার।
ক) এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কোথায় ছিল যখন বিবিসির তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া দ্য মোদী কোয়েশ্চেন। গুজরাত দাঙ্গার সব সত্য সামনে এসে যাবে বলে রাতারাতি নিষিদ্ধ করা হল তথ্যচিত্রটি। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহকে বাঁচাতে সমস্ত ইউটিউব এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও এই সংক্রান্ত লিঙ্ক মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাতের অন্ধকারে ভারতে জগৎ বিখ্যাত বিবিসির কার্যালয়ে হল কেন্দ্রীয় এজেন্সির হানা। রাতভর তল্লাশি, অপমান,হেনস্থা। তখন কোথায় লুকিয়ে ছিল বিবেক অগ্নিহত্রি এবং তার বিবেক?
খ) ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা এখনও ভারতীয়দের জন্য হয়ে আছে দগদগে এক ক্ষত হিসেবে। ধর্মীয় রেষারেষি আর অন্তর্দ্বন্দ্বের ছোবলে গুজরাটে এই দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই হাজারেরও বেশি সংখ্যালঘু। পরিচালক রাহুল ঢোলাকিয়া ২০০৫ সালে এসে এই দাঙ্গাকে ঘিরে নির্মাণ করেন পারজানিয়া, যার কেন্দ্রে ছিল গুজরাটে দাঙ্গাচলাকালে নিখোঁজ হয়ে পড়া এক ইরানি দম্পতির সন্তান। দাঙ্গার ফলে সৃষ্ট গণহত্যা’র বীভৎসতা এবং চরিত্রগুলোর মর্মান্তিক পরিণতি সিনেমাটিতে দেখানো হয়। জাতীয় পুরস্কার জেতা এই সিনেমা অবশ্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় গুজরাতে ক্ষমতায় থাকা ভাজপার কাছে।ইতিহাসের কালো অধ্যায়কে ঢেকে ফেলতে রাতারাতি সিনেমাটি নিষিদ্ধ করা হয় গুজরাতে। বিবেক বাবুর বিবেক ঘুমাচ্ছিল?
গ) আমরা ভুলে যায়নি শাহরুখ খানের মাই নেম ইজ খান ছবিটির কথা। করণ যহরের এই ছবির জন্য শাহরুখকে অ্যান্টি ন্যাশনালিস্ট বলে শিবসেনা যখন মহারাষ্ট্রে এই ছবির পোস্টারে আগুন লাগিয়ে সিনেমা হল বন্ধ করে দিল, তখন ভাজপার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং আর এস এস পুরো সমর্থন জুগিয়েছিল, তখন শিল্পের অবমাননা মনে হয়নি?
ঘ) আমির খান অভিনীত কুণাল কোহলির ফানা ছবিটার কথা ভুলে গিয়েছে ভাজপা ? নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে হাজির হওয়া মাত্র নরেন্দ্র মোদী ২০০৬ সালে এই ছবি গুজরাতে নিষিদ্ধ করেন। তখন অমিরও হয়ে উঠলেন অ্যান্টি ন্যাশনাল। আজকের সাংস্কৃতিক মনস্করা তখন চুপ ছিলেন কেন?
ঙ) এই তো সেদিনকার কথা। ২০১৮, সঞ্জয় লীলা বনসালির পদ্মাবত ছবির সেটে ঢুকে পরিচালকের গালে থাপ্পড় মারল ভাজপার সহোদর বজরং দল। ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি হলেআগুন লাগানো। মুক্তি পিছিয়ে গেল। ভাজপা অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে বন্ধ হল শো। সুপ্রিম কোর্টে গেল প্রযোজক। শেষে নাম বদলে,দৃশ্য বদলে মুক্তি।
চ) ভুলে গেলে চলবে না সেই বছরই মুক্তি পাওয়া অনুরাগ সিনহার ছবি মুল্ক। ঋষি কাপুর অভিনীত এই ছবিতে সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে একজন ভারতীয় নাগরিককে পাকিস্থানি ও দেশদ্রোহী বলে সামাজিক হেনস্থার ঘটনা দেখানো হয়েছে। যা সত্য ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত। উত্তরপ্রদেশ সবার আগে লাফ দিয়ে আসরে নামে এবং এই ছবির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। হিন্দু সেনা, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ একাধিক সংগঠনকে আসরে নামানো হয়। যদিও ছবি প্রদর্শন রোখা যায়নি।
ছ) আর একটা সিনেমার নাম তো ভুলেই গিয়েছেন ভাজপার শিল্পবোধের ধারকরা। সেটা হল, নন্দিতা দাস পরিচালিত প্রথম সিনেমা ফিরাক। নাইসুদ্দিন শাহ,দীপ্তি নাভাল অভিনীত এই ছবি ২০০৯ সালে গুজরাত দাঙ্গার পরবর্তী সামাজিক ঘৃণার আধারে নির্মিত। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও নরেন্দ্র মোদী এই ছবিকে গুজরাতে নিষিদ্ধ করেন।
অন্তত ২২ টি তথ্যচিত্র আছে যা গুজরাতে মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যার অধিকাংশ খোঁজ গুগুলেও মুছে ফেলা হয়েছে। ইউটিউব এ প্রশ্নই নেই। দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য তৈরি কেরালা স্টোরি নিষিদ্ধ হলে গেল গেল রব, আর ভাজপা নিজের স্বার্থে কত ডজন সিনেমা,শিল্প,নাটক নিষিদ্ধ করেছে তার জন্য নিঃশব্দ এই তথাকথিত গেরুয়া বুদ্ধিজীবীরা। এদের দ্বিচারিতার মুখোশ এবার খুলে ফেলার সময় এসেছে।