Last Updated on November 4, 2023 7:05 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে গিয়েছে একের পর এক বাড়ি। খেলনার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে গাড়ি, আসবাব, বিশালাকার হোর্ডিং, রাস্তায় চওড়া ফাটলতছনছ হয়ে গিয়েছে নেপালের প্রাণকেন্দ্র দরবার স্কোয়ার। ২০১৫-র ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আতঙ্ক ফিরল ২০২৩-এ। শুক্রবার রাতের ভূমিকম্প ইতিমধ্যেই প্রাণ কেড়েছে ১৩০ জনের। জখম ৫০০-র বেশী। তবে এই পরিসংখ্যান সরকারি। বেসরকারি মতে, মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, প্রত্যন্ত অনেক জায়গাতে এখনও উদ্ধারকারী দল পৌঁছোতেই পারেনি। ফলে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আরও কতো দেহ উদ্ধার হবে তা এখনও আঁচ-ই করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল ক্ষতি যে শুধু প্রাণহানি তা তো নয়, একের পর এক মারাত্মক ভূমিকম্পের ফলে নেপালের যে হেরিটেজ তাও ভয়ঙ্কর ভাবে বিপদে পড়ছে। ২০১৫ -র ভূমিকম্পে দরবার স্কোয়ার তো বটেই কাঠমান্ডু এবং আশপাশের শতাধিক প্যাগোডা মন্দির মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জাপানি অর্থ সাহায্যে সে সবের সংস্কার শুরু হয়েছে তার মধ্যেই এই প্রবল ভূমিকম্পে সেগুলিতে নতুন করে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন চলতে থাকলে ইতিহাস থেকে পাকাপাকিভাবে হারিয়ে যেতে পারে নেপালের শত সহস্র বছরের প্রাচীন স্থাপত্য।
হঠাৎ প্রবল কম্পন, আর্তনাদ, অন্ধকার
শুক্রবার তখন নেপালের স্থানীয় সময় রাত ১২ টা। আচমকা প্রবল কম্পন। মাঝরাতে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল একের পর এক বাড়ি, চোখের নিমেষে লন্ডভন্ড গোটা নেপাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের তরফে জানানো হয়, ১১ মাইল পর্যন্ত ৬.৪ মাত্রার এই কম্পন হয়। নেপালের ন্যাশনাল আর্থকোয়েক মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার জানিয়েছে, এই কম্পনের এপিসেন্টার জজরকোট। যা কাঠমান্ডুর উত্তর পূর্ব থেকে ২৫০ মাইল দূরে। ভূমিকম্পের প্রাবল্যে গোটা নেপাল অন্ধকারে ডুবে যায়। চারিদিকে আর্তনাদ, হাহাকার। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে রাতে উদ্ধারকাজ শুরু হলেও বহু জায়গায় পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যে ঊদ্ধারকারী দল পৌঁছোতেই পারেনি। রাতেই নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়ায়। এর পর সময় যত গড়িয়েছে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত এবং আহতের সংখ্যা। নেপালের এই ভূমিকম্পের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে রুকুম জেলায়। সে জেলার প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একাধিক বাড়ি ধসে পড়েছে। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক নরভরাজ ভট্টরাই জানিয়েছেন, একাধিক আহত ব্যক্তিকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জজরকোট জেলার স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের আধিকারিক হরিশ চন্দ্র শর্মা জানান, তাঁদের হাসপাতালে মোট ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় আধিকারিকরা জানিয়েছেন, জাজারকোটের অনেকগুলি এলাকায় এখনও উদ্ধারকারী দল পাঠানো সম্ভব হয়নি। এই পাহাড়ি জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলিতে প্রায় দু’লক্ষ মানুষের বাস। শুক্রবার রাতের ভূমিকম্পের পর বেশ কিছু এলাকার সঙ্গে প্রশাসনের তরফে এখনও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
ফিরল ২০১৫-র আতঙ্ক
২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল। বেলা ১২টা নাগাদ রিখটার স্কেলে প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের অভিঘাতে কেঁপে ওঠে নেপালের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি। কেন্দ্রস্থল ছিল গোর্খা জেলার বারপাক। ভূমিকম্পের তাণ্ডবে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন প্রায় ২২ হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় দরবার স্কোয়ার সহ প্রায় গোটা কাঠমান্ডু। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় নেপাল। শতবর্ষ পুরনো যে সব বিল্ডিং-কে হেরিটেজ তকমা দিয়েছিল ইউনেস্কো, সেগুলিও ভেঙে পড়ে এক লহমায়। মাটির সঙ্গে মিশে যায় কাঠমাণ্ডু দরবার স্কোয়ার, বৌদ্ধনাথ স্তূপ, স্বয়ম্ভূনাথ স্তূপ, চাঙ্গু নারায়ণ মন্দির। উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার আগেও মৃতের সংখ্যাটা আন্দাজ করতে পারেননি অনেকেই। এরপর শুধুই মৃত্যুর খবর সামনে আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৯০০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। ৮ বছর পর ভূমিকম্পের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ফিরল নেপালে। সেই আর্তনাদ, হাহাকার, মৃত্যু মিছিল। ভেঙে পড়া বাড়ি, ধ্বংসস্তূপের পাহাড়, রাস্তায় ফাটল, পাহাড়ে ধস। নেপাল সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ২০১৫ সালের ভূমিকম্প ছিল অতি প্রবল কম্পন। শুক্রবার রাতের কম্পন প্রাবল্যের নিরিখে কিছুটা কম হলেও তাতে ক্ষতির বহর কম কিছু নয়। এখনও পর্যন্ত যা খবর এসেছে তাতে দরবার স্কোয়ারের একাধিক বাড়িতে ফাটল ধরেছে। কিছু মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। একাধিক রাস্তায় ফাটল ধরেছে। কাঠমাণ্ডুতে মৃতের সংখ্যা কম হলেও প্রত্যন্ত এলাকার পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর।
কেন বার বার কাঁপে নেপাল
হিসেব বলছে গত এক মাসের মধ্যে নেপালের মাটি তিন বার কেঁপে উঠেছে। গত ২২ অক্টোবর কেঁপে উঠেছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.১। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নেপালের ধাদিং জেলা। এর ঠিক দু’দিন পরে আবার ভূমিকম্প হয় নেপালে। মাত্রা ছিল ৪.১। গত ৩ অক্টোবরও ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল নেপাল। পর পর চার বার ভূমিকম্প হয়েছিল নেপালে। ফলে বড় বিপর্যয় যে আসন্ন সেই আশঙ্কা ছিল-ই। তাই সত্যি হল শুক্রবার রাতে। তবে গত ১০০ বছরে প্রায় প্রতি বছর-ই ছোট বড় একাধিক কম্পন অনুভূত হয়েছে নেপালে। হাজার হাজার প্রাণহানি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, নেপাল বিশ্বের অতি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। নেপাল বিশ্বের ১১তম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। তিব্বতীয় এবং ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত হওয়ায় নেপাল প্রায় সারা বছরই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে থাকে।
কাঁপল ভারতের একাংশ
শুক্রবার রাতের ভূমিকম্পে কাঁপল ভারতের একাংশ-ও। রাত সাড়ে ১১ টার কিছু পরে মাঝারি কম্পন হয় দিল্লি, এনসিআর, বিহার, লখনউ সহ উত্তর এবং পূর্ব ভারতের কিছু অংশে। কম্পন অনুভূত হয় উত্তরাখণ্ডের কিছু কিছু অংশ, চণ্ডীগড়, জয়পুরেও।
আতঙ্কে বহুতল ছেড়ে নেমে আসেন বহু মানুষ। তবে ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোনও খবর নেই।