Barbie Movie Review: বার্বিল্যান্ড থেকে রিয়েলিটিতে বার্বি এল দুনিয়া দখল করতে, পুতুলের ক্যামোফলেজে আসলে নারীর ক্ষমতায়নের গল্প

0

Last Updated on August 10, 2023 8:24 PM by Khabar365Din

৩৬৫ দিন। সিনেমার ট্যাগ লাইন ছিল, যদি আপনি বার্বি ভালোবাসেন এই ছবি আপনার, যদি আপনি বার্বি নাও পছন্দ করেন,তবুও এটি আপনারই ছবি। অবশ্যম্ভাবী এক ভবিষ্যতের বার্তা এই ক্যাচ লাইনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। যা ঘটতে চলেছেই। আমরা চাইলেও ঘটবে,না চাইলেও ঘটবে। আগামী ভবিষৎ যে নারীদের হাতেই নির্দিষ্ট হতে চলেছে তার আগাম ইঙ্গিত দিয়েছে বার্বি। যে যাই বলুক,বার্বি সমাজে সমতা দেখায় নি।বরং প্রতিষ্ঠা করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতা। কয়েকবছর আগেও এশিয়া আর ইউরোপ জুড়ে অন্তত দশটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন মহিলা। ১২২ টি আন্তর্জাতিক কর্পোরেট জায়েন্টদের মধ্যে ৩৫ টি কর্পোরেট দৈত্যের সিইও মহিলা। দুই আমেরিকা,ইউরোপের ১৪ টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বিচারক, আমলা, মহিলা। এখন আর কেবল শতাংশের হিসাবে সংরক্ষণ নয়, পূর্ন দাবিতে যোগ্যতামান পেরিয়ে বার্বিদের যুগ আসছে,তারই বার্তা দিল গোলাপী বার্বির জগৎ।

ছবিতে দুটি তত্ত্ব বা থিওরি সমান্তরাল চলেছে। একটি, ফ্যান্টাসি ছবি হয়েও বাস্তবের পথে চলার,হার্ড রিয়েলিটি খুঁড়ে বের করার তত্ত্ব। অন্যটি ভবিষৎ সমাজে নারীদের ক্ষমতাদখলের থিওরি। বার্বি এ এক আজব পুতুলনাচের ইতিকথা। অবাস্তবতার জগৎ থেকে স্বপ্ন সুন্দরী বার্বি পুতুলের রিয়েলিটিটে আগমনও বলা যায়। লুইস ক্যারল যেমন ছোট্ট অ্যালিসকে বাস্তবের দুনিয়া থেকে এক আজব ফ্যান্টাসি দুনিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন,পরিচালক গ্রেটা গারউইক তার রিভার্স টার্ন বা উল্টো যাত্রা দেখিয়েছেন। এখানে ইউটোপিয়ান বার্বিল্যান্ড থেকে বার্বি গার্ল বাস্তবের জগতে আসে। একই সঙ্গে দ্বিমুখী তত্ত্বে ভর করে বার্বি নারীকেন্দ্রিক ও ফেমিনিন এক ইউনিভার্স থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আসে। একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে মুক্তি পাওয়া বার্বি আর ওপেনহাইমারের ব্যবসার লড়াইয়ে কে শেষ পর্যন্ত জিতবে সেটা পরের কথা, কিন্তু একটা অতি বাস্তব,ভয়াবহ ঐতিহাসিক মারণতন্ত্রের সিনেমার সঙ্গে সমান্তরাল পাল্লা দেওয়া কিউট বার্বি কিন্তু থিওরিতে এগিয়ে। বার্বি ছবিতে প্রতিষ্ঠিত গোটা বিশ্বজুড়ে ফেমিনিন ডমিনেন্স এর থিওরির কাছে ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কোয়ার পিছিয়ে। ওপেনহাইমারের মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মতোই ভবিষৎ বিশ্বে নারী কেন্দ্রিক সভ্যতার অবশ্যম্ভাবী চেইন রিয়াকশন শুরু হতে বাকি নেই, তা পরিষ্কার করে গিয়েছেন ৫ বার অস্কারে মনোনীত হওয়া সুন্দরী অভিনেত্রী পরিচালক গ্রেটা।

দেখতে সে নয় মন্দ / আহা পুতুল পুতুল গড়ন। নায়িকার ভূমিকায় ছবিতে অনুপ ঘোষালের গাওয়া গানটি নিশ্চই মনে আছে দর্শকদের। বার্বি মানেই সেই সুন্দর মিষ্টি পুতুল। তবে এ পুতুল ভাবুক,চিন্তাশীল এবং প্রেমিকা। বর্বিল্যান্ড এমন এক জগৎ যেটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ দিয়ে গঠিত। এখানে বার্বিরা দম দেওয়া পুতুল নয়। তাদের সত্ত্বা আছে, চেতনা আছে, মনন ও সৃজনশিলতা আছে। তারা ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, সমাজের সব গুরুত্বপূর্ন পদে আছে। আমাদের গল্পের বার্বি(মার্গো রবি) তার বন্ধু ও সহকর্মী কেনের (রায়ান গোজলিং) সঙ্গে মিষ্টি প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। হঠাৎই পার্টিতে নাচের সময় বার্বি প্রথমবার নিজের মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই প্রথম মৃত্যুভয় তাকে গ্রাস করে। ঘুম থেকে উঠে সে লক্ষ্য করে রক্ত মাংসের মানুষের মত তার পায়ের পাতা ফ্ল্যাট হয়ে উঠছে। চিন্তিত বার্বিকে বাস্তব জগতে যাওয়ার পরামর্শ দেয় বার্বিল্যান্ডের ওয়াইজ বার্বি।

কেন ও বার্বি এই বাস্তব জগতে এসে পরে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ,বাস্তবের কঠোরতা, ট্যাবু বার্বি আর কেনকে ক্ষতবিক্ষত করে। হালকা কমেডির মধ্যে দিয়ে সে যাত্রা শুরু হলেও ক্রমশ বাস্তবের সমাজ একটু একটু করে নখ দাঁত বের করে। অন্যদিকে ম্যাটেল কোম্পানি যারা বার্বি পুতুল বানায়, তারা বুঝতে পারে রক্ত মাংসের বার্বি ঘুরে বেড়ালে পুতুল বিক্রি সম্ভব নয়। বার্বিকে ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাস্তব দুনিয়ায় পিতৃতন্ত্রই ক্ষমতার উৎস বার্বি বুঝতে পারে। পুরুষ হওয়ার জোরেই গোটা সমাজের মাথা হয়ে উঠতে পারবে সে। তার চলাফেরাতেও আস্তে আস্তে ধরা পড়তে থাকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস। ম্যাটেল কোম্পানির হাত থেকে বাঁচতে তারা বার্বিল্যান্ড ফিরে যায়। বার্বিল্যান্ডে ফিরে পিতৃতন্ত্র চালু করবে ,এই পরিকল্পনা করেছিল কেন। বার্বিল্যান্ডে ফিরে আসার সব বদলে দেয় সে। কেনরা সেখানে রাজত্ব শুরু করে, গোলাপী বার্বির জগৎ তখন মুছে গিয়েছে। বার্বিরা সবাই বঞ্চিত। কিভাবে বার্বির গোলাপী জগৎ ফিরে আসবে সেটা দেখার জন্য সিনেমাটা দেখতে হবে।

১৯৫৯ সালে রুথ হ্যান্ডলার বার্বি পুতুল নির্মাণ করেন। তাঁর ম্যান্টেল কোম্পানি এই বার্বিকে প্রায় বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শিশুদের কাছে পৌঁছে দেয়। বার্বির জনপ্রিয়তা এমনই জায়গায় পৌঁছয়, স্বয়ং হলিউড সেনসেশন মেরিলিন মুনরো বলতেন,আমি বার্বিকে হিংসা করি। ও এত সুন্দর। নব্বই দশক পর্যন্ত শিশুকন্যাদের জন্মদিন বার্বি উপহার ছিল মাস্ট। এর তিন বছর বাদে বার্বির পুরুষ বন্ধু কেনের আগমন। বার্বিকে নিঃসঙ্গ রাখতে চাননি রুথ হ্যান্ডলার। উওমেন এম্পাওয়ার মেন্ট রিভলিউশন তখনও জাঁকিয়ে বসেনি। এই ছবিতে সেই বার্তা অতিক্রম করে সমাজে পুরুষের অবস্থানকে নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিয়েছেন পরিচালক। তাই বার্বি কখনোই কল্প বিজ্ঞানের ছবি নয়। গোলাপি পোশাক গায়ে সিনেমা দেখলেও বার্বি অত গোলাপী নয়, বরং হার্ড এবং উজ্জ্বল সাদা।

মধ্যপ্রাচ্যে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বার্বি প্রদর্শন

পুরুষ পুতুল কেনকে তার বন্ধুরা বলছে, বার্বি যদি তোমায় পাত্তা না দেয়, মনমরা হয়ে থেকো না, আমরাও তো ভালো বন্ধু। এইটুকু সংলাপ নিয়েই যত ঝামেলা। একই সঙ্গে বার্বি ছবির থিম কলার আবার পিংক। যাকে বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। বার্বি ছবিটা পুরোটাই নাকি রূপান্তরকামীদের জন্য তৈরি হয়েছে। শুধু মাত্র এলজিবিটি সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করার জন্যই পরিচালক এটা করেছেন। এমনটাই অভিযোগ উঠেছে গোটা মিডল ইস্ট জুড়ে। যা তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতির সম্পূর্ন বিরোধী। এর ওপর আবার জানা গিয়েছে পরিচালক গ্রিটা নাকি ইচ্ছে করেই মোট ১৪ জন বিখ্যাত রূপান্তরকামী অভিনেতাকে এই ছবিতে নিয়েছেন। যার মধ্যে অতি বিখ্যাত হ্যারি নেফ,কেট ম্যাকনিনন,অ্যালেখজন্দ্রা শিপ এবং স্কট ইভান্স এর মত অভিনেতারা রয়েছেন। যারা আমেরিকায় এবং ইউরোপ এলজিবিটি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। অতএব তাদের যুক্তির সঙ্গে অকাট্য প্রমাণও আছে বলে দাবি করেছে আরব আমিরশাহীর সংস্কৃতি দফতর। একই সঙ্গে এই ছবি প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চলেছে মিডল ইস্টের আরও দেশগুলো। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, কুয়েত , কাতার এবং বাহারিন। ইতিমধ্যে এই বার্বি বয়কট ব্যানারে যোগ দিতে চলেছে ইজিপ্টও। তাদের প্রশাসনের বক্তব্য আমাদের ভাবনায় ও সংস্কৃতিতে আঘাত করে হলিউড নিজের ব্যবসা করে যাবে তা হতে দেব না।

বার্বি ছবিতে বার্বি ডলের
স্রষ্ঠা ৮৫ বছরের রুথকে এনে শ্রদ্ধা

৩৬৫ দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবহ শেষ হতে না হতেই, এশিয়া, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা, মিডল ইস্ট, পূর্ব ইউরোপ জুড়ে শুধু ধবংস আর মৃত্যুর মাঝেই মার্কিন উদ্যোগপতি রুথ হ্যান্ডলার তার মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন বার্বি নামের মিষ্টি মেয়ে পুতুলটা বাজারে এনে। ৬৪ বছর আগে ১৯৫৯ সালে যাত্রা শুরু করা সেই বার্বির স্রষ্ঠাকে পর্দায় এনে সন্মান জানালেন বার্বির পরিচালক গ্রিটা। ৮৫ বছরের রুথকে পর্দায় দেখে অনেকেই চিনতে পারেনি। চেনা সম্ভবও নয়, কিন্তু প্রিমিয়ারের দিন ক্যালিফোর্নিয়ায় দর্শক স্ট্যান্ডিং অভেশন জানিয়েছিলেন রুথকে। ম্যাটেল কর্পোরেশনের স্রষ্ঠা রুথ বার্বি মুভি দেখে অভিভূত বলে জানিয়েছেন।

স্পেস ওডিসি অনুপ্রাণিত বিশাল বার্বির দৃশ্য

৩৬৫ দিন। বার্বি ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই চমকের পর চমক। শুরুতেই যে দৃশ্যটি থ্রিডি স্ক্রিনে দেখে দর্শক ওয়াও! বলে উঠছে, সেটার ভাবনা পরিচালক গ্রিটা নিয়েছিলেন ২ বছর আগেই। আজব এবং অদ্ভুত সেই দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, ছোট মেয়েরা তাদের প্রিয় বার্বি নিয়ে খেলছে। হঠাৎই সামনে উদয় হয় পাহাড়ের মত এক বিশাল বার্বি। মহাজাগতিক সেই দৃশ্য যেন এই বাস্তব পৃথিবীর কোনও জায়গা নয়,বরং অজানা কোনও দুর গ্রহের মত। হালকা লালচে,ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথুরে জমি,ঠিক যেন মঙ্গল গ্রহ। অতিপ্রাকিত সেই দেশে বিশালাকার বার্বির কাছে সবাই যেন লিলিপুট। আশ্চর্য লাগলেও এই ছবিতে পরিচালক গ্রিটা নারীত্বকে লার্জার দ্যান থিঙ্ক করে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু মূল কথা হল এই দৃশ্যটি হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের অতি জনপ্রিয় সাইন্স ফিকশন ২০০১ আ স্পেস ওডিসি থেকে কপি করা। ২০০১ সালের সেই ছবিতে এমনই একটি দৃশ্যে সামনে আসে অকল্পনীয় উচ্চতার একটি মনোলিথ পাথরের টুকরো। সেখানে কুবরিক প্রতিষ্ঠা করেছেন, মানুষ এই মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে অতি অতি ক্ষুদ্র, কণা মাত্র। সেই দৃশ্যেও দেখা গিয়েছিল এমনই মহাজাগতিক রং এবং বৈশিষ্ট্যের একটি গ্রহ। বার্বির পরিচালক তার টুইটারে বরেণ্য পরিচালক কুবরিককে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচালক লিখেছেন, স্যার স্ট্যানলি আমায় এই আইডিয়া দেন। ওই দৃশ্য রূপায়ণে ওর মতামত এবং সাহায্য আমি পেয়েছি,বলতে গেলে এই দৃশ্য ওরই নির্মাণ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।