Last Updated on April 21, 2023 6:38 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। নয়াদিল্লি। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। প্রত্যেকের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। ভালোবাসার কোনও ধর্ম হয় না। ভালোবাসার কোনও সীমানা নেই। তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই পছন্দসই জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তা সে জীবনসঙ্গী নারী বা পুরুষ, যে কেউ হতে পারে। এসব বিষয় ঠিক করার কোনও অধিকার আমার নেই। কিন্তু, আমি বিশ্বাস করি যে প্রত্যেক মানুষের ভালোবাসার অধিকার আছে। জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। তবে, আমি বিশ্বাস করি যে সুপ্রিম কোর্ট গণতন্ত্রকে সঠিক দিশা দেখাবে। সুপ্রিম কোর্টে ভাজপা শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার যখন দেশে সম্মলিঙ্গে বিবাহ নিয়ে প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোড়ামি থেকে সম লিঙ্গে বিবাহের তীব্র আপত্তি জানিয়েছে তার মধ্যেই ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে নিজের মতামত জানালেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দেশের প্রতিটি রাজ্যের সরকারের কাছ থেকে সমলিঙ্গে বিবাহ স্বীকৃতি দেওয়া হবে কিনা সেই বিষয়ে রাজ্যগুলির মতামত জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
অকাট্য প্রশ্নে কেন্দ্রের যুক্তিখন্ডন প্রধান বিচারপতির
বৈবাহিক সম্পর্কে দুই ব্যক্তির বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হওয়া কি অত্যাবশ্যক? একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের বিবাহ হলে যে সন্তান জন্ম নেয় সেই সন্তান যে সুস্থ পরিবার এবং সুস্থ পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠবে তার নিশ্চয়তা কে দেবে? যে সন্তান জন্মের পর থেকে দেখে আসছে তার বাবা মদ্যপ অবস্থায় রোজ রাতে বাড়ি ফিরে মাকে নির্যাতন করছে অথবা দৈনন্দিন পারিবারিক কলহের মধ্যে তার শৈশব নষ্ট হচ্ছে সেই বিবাহ যদি আইনি স্বীকৃতি পেতে পারে তাহলে সমলিঙ্গের দুজন সুস্থ ব্যক্তি সন্তানের দায়িত্ব নিলে সেই সংসার বা সেই পরিবার সুস্থ হবে না কোন যুক্তিতে? ভারতের সম লিঙ্গে বিবাহের স্বীকৃতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে শুনানির মধ্যেই এমন প্রশ্ন করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।
তৃতীয় দিন মামলার শুনানি চলাকালীন আজ প্রধান বিচারপতি বলেন, এই ধরনের সম লিঙ্গে সম্পর্ককে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্ক হিসেবে দেখি না আমরা। বরং এই ধরনের সম্পর্ক তার চেয়ে বেশিই, স্থিতিশীল, আবেগমিশ্রিত এবং মানসিক সংযোগও জড়িয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষে বর্তমান আইনে সমকামী সম্পর্ক অপরাধের আওতায় না পড়লেও, সমলিঙ্গের বিয়ে আজও নিষিদ্ধ দেশে। সেই নিয়ে শুনানি চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় প্রশ্ন তোলেন, বিবাহিত সম্পর্কে বলতে যা বুঝি আমরা, তাতে দুই মানুষকে বিপরীত লিঙ্গেরই হতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা রয়েছে কিনা।
আজ শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি জানান, ১৯৫৪ সালে দেশে বিশেষ বিবাহ আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে, গত ৬৯ বছরে আইনেও রদবদল ঘটেছে বিস্তর। তাই সামাজিক ধ্যান-ধারণা, গণ্ডির বাইরে নিজেদের দেখেন যাঁরা, তাঁদেরও বিবাহের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, সমকামিতাকে অপরাধমুক্ত করে আমরা শুধুমাত্র সমলিঙ্গের, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় অনুমোদন দিইনি, তাঁদের লিভ-ইন সম্পর্ককেও বৈধতা দিয়েছি।
মামলার প্রেক্ষিত
প্রেম যে শুধু নারী-পুরুষেই আবদ্ধ থাকবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। দুই নারী বা দুই পুরুষ জড়াতে পারেন ভালবাসার আবদ্ধে। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে কোনও নারী বা পুরুষের। প্রথাগত নারী-পুরুষের সম্পর্কের বাইরে এ ধরনের সম্পর্কের বৈবাহিক স্বীকৃতির জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। পাঁচ বিচারপতির বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চে চলছে সেই মামলার শুনানি। যদিও কেন্দ্রের ভাজপা সরকার এই আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করেছে।
সমলিঙ্গ বিবাহে কেন্দ্রের বিরোধিতা
সমলিঙ্গে বিয়েকে আইনি স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যে একগুচ্ছ মামলা দায়ের হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে সেই মামলার শুনানির বিরোধিতা করেন কেন্দ্রের প্রতিনিধি তথা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। সমলিঙ্গে বিয়ের আইনি স্বীকৃতির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র যে হলফনামা পেশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে সমলিঙ্গের সম্পর্কের সঙ্গে ভারতীয় পারিবারিক সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা চলে না। ভারতীয় পরিবারের ধারণা হল স্বামী, স্ত্রী এবং তাঁদের সন্তান। সমলিঙ্গ বিবাহ এবং অসমলিঙ্গ বিবাহের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। তাই দুটোকে এক ভাবে দেখা উচিত নয়। তুষার মেহতা সওয়াল করেন, সমলিঙ্গের বিয়েকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে একমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংসদ। আদালতের থেকে সমলিঙ্গ বিবাহের যে স্বীকৃতি চেয়েছেন মামলাকারীরা, তা সম্পূর্ণ ভুল প্রক্রিয়া। আদালতের কাছে সেই ক্ষমতা নেই। সেজন্য ওই পিটিশনগুলি না শোনার আর্জি জানান সলিসিটর জেনারেল। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের এই দাবি খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে বিবাহের জন্য নারী এবং পুরুষের মধ্যেই বিয়ে হতে পারে বলে ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়েছে, তার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চের কঠোর পর্যবেক্ষণ, এটা শুধুমাত্র যৌনাঙ্গের গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকতে পারে না। এই বিষয়টা তার থেকে অনেক বেশি জটিল। কে পুরুষ এবং কে মহিলা, সেটার ধারণা শুধুমাত্র আপনার যৌনাঙ্গের উপর নির্ভর করে না।
বিশ্বের বহু দেশে স্বীকৃত সমলিঙ্গে বিবাহ
বিশ্বের প্রায় ৩৪ দেশে বৈধ সমকামী বিবাহ। ২০০১ সালের পর থেকে এই সব দেশে সমলিঙ্গ বিবাহ স্বীকৃত হয়েছে। এ ব্যাপারে পথ দেখিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। ইউরোপের এই দেশে ২০০১ সালে স্বীকৃতি হয় সমলিঙ্গে বিবাহ আইন। সেই প্রথম। তার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমলিঙ্গের অধিকার রক্ষায় সমলিঙ্গে বিবাহ স্বীকৃতির দাবি ওঠে। ২০১৮ সালেও ভারত সরকারের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট ভারতে সমকামী সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিল।