Last Updated on March 14, 2022 1:32 AM by Khabar365Din
১. মাননীয় শত্রুঘ্ন সিনহাকে (Shatrughan Sinha) আমি চিনি ৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে। তখন যে বাংলা দৈনিকে চাকরি করি, সেই পত্রিকার পক্ষ থেকে হার্ড নিউজের পাশাপাশি ‘টেলিভিশন’ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় দায়িত্বে আছি। আলাপের শুরুটা তীব্র বিতর্কিত। শত্রুঘ্ন বাংলায় ফিল্মসিটি করতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে বৈঠকও করেন। যথারীতি বৈঠক ব্যর্থ হয়। খবর পাওয়ামাত্র আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করি এবং দু-একদিনের মধ্যে বুদ্ধবাবুকে তীব্র আক্রমণ করে শত্রুঘ্ন’র পাতাজোড়া ইন্টারভিউ প্রকাশ করি। বুদ্ধবাবু হিন্দি সিনেমার সঙ্গে জড়িতদের মন থেকে ঘৃণা করতেন। ফলে বাংলায় ব্যবসা আসার সুযোগ সত্ত্বেও প্রকল্পটি কিছু বাজে অজুহাত দেখিয়ে নাকচ করে দেন। শত্রুঘ্ন’র অকাট্য যুক্তি সম্পর্কে আমার তখ নই একটা আস্থা তৈরি হয়। পরবর্তী ৩০ বছর ধরে উনি বস্তুত আমার একজন প্রিয় দাদা ও বন্ধু হয়ে ওঠেন। বাংলায় প্রথম সর্বভারতীয় টেলিভিশন পুরস্কার চালু করা হল। শ্যাম বেনেগাল, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি, শাবানা আজমি, গোবিন্দ নিহালনি, কেতন মেহতা, বি আর চোপরা (মহাভারত) এরা সকলেই কলকাতায় এলেন পুরস্কার নিতে। সঙ্গে শত্রুঘ্নকে আমন্ত্রণ জানানো হল। দুর্দান্ত বক্তৃতা দিলেন। ভারতে সরকার নিয়ন্ত্রিত দূরদর্শন মিডিয়াটি কীভাবে সরকারের ধামাধরা হয়ে উঠেছে তার বিরুদ্ধে। মানহানি বিলের বিরুদ্ধে সেমিনার করা হল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে। ন্যাশনাল স্পিকারদের মধ্যে অরুণ শৌরি, কুলদীপ নায়ার আর শত্রুঘ্ন। যে ভঙ্গিতে কংগ্রেস সরকারকে আক্রমণ করলেন তাতে হাততালির ঝড় তো উঠলই সঙ্গে যেটা হল সিপিএম মহলে রটে গেল মুম্বইয়ের এই অভিনেতাটি শুধু স্পষ্টভাষী নন, সুবক্তা এবং কংগ্রেস বিরোধী তীব্র আক্রমণে অভ্যস্ত। এসএফআই-এর এক সম্মেলনের জন্য স্বয়ং সোমনাথ চাটুজ্জ্যে আমায় অনুরোধ করেন শত্রুঘ্নকে বক্তা হিসেবে নিয়ে আসার জন্য। শত্রুঘ্ন রাজি হন। সেই সময়ে মুম্বইয়ে নম্বরের দিক থেকে অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র, জীতেন্দ্র’র সমকক্ষ ওই অভিনেতা, যার জেভিপিডি স্কিমে ‘রামায়ণ’ বাংলোটি ঠিক বচ্চন সাহেবের ‘প্রতীক্ষা’র উল্টোদিকে, কোনও ট্যানট্রাম ছাড়াই সেই স্টার অভিনেতা এসএফআই-এর পাঠানো একটা ভাঙা অ্যাম্বাসাডারে ঢংঢং করতে করতে হোটেল থেকে চলে গেলেন সভাস্থলে। এই বড় হৃদয়ের এবং শতকরা একশোভাগ সমাজ সচেতন মানুষটির সঙ্গে ৮০’র শেষে, রাজীব বিরোধী ভিপি’র সমর্থনের ভোটে গোটা বিহার ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনো কোনো রাতে টকিং পয়েন্টস্ তৈরিতে সাহায্য করেছি। বিহারে ওই সফরে বিহারীবাবুর জনপ্রিয়তা দেখে অবাক হয়েছি। শুধু আমি নই, রাজীব গান্ধিও চিন্তিত হয়েছিলেন।
২.সমাজ সচেতন অনেকেই হন, পরিণত রাজনীতিবিদ সবাই হতে পারেন না। অনেকে বলেন, সেন্স অফ হিউমার বেশি থাকলে পরিণত রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। মডেল জ্যোতিবাবু। ভদ্রলোক হাসতেন না। আমি একেবারেই মানি না। যতদূর জানি নরেন্দ্র মোদিও হাসেন না। স্তালিনের কৌতুক বোধ এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ যথেষ্ট (অপেরা শুনতে যেতেন), কিন্তু হিটলার ওসবের ধার ধারতেন না, এমনকি ঘনিষ্ঠ মহলের চালু জোক শুনেও বুঝতে পারতেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) আড্ডায় যাদের যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে, তারা জানেন এই নেত্রী চরম রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও নিজে হাসতে এবং অন্যকে হাসাতে দ্বিধা করেন না। সেন্স অফ হিউমার না থাকলে পরিণত রাজনীতিবিদ হয়তো হওয়া যায়, মানুষের কাছাকাছি আসা যায় না। শত্রুঘ্ন তথা শটগান জানেন কখন হিউমার আর কখন স্যাটায়ার করতে হয়। ওঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ উনি বারবার দল পাল্টেছেন। শত্রুঘ্ন শখের রাজনীতি করতে আসেননি। স্বস্তি পাননি বলেই দল পাল্টেছেন। বাজপেয়ি’র সময় সরকারের জাহাজ ও স্বাস্থ্য দুটি দফতরের মন্ত্রী থাকার পরেও দু’বার লোকসভা, দু’বার রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পরেও মোদি-শাহ’র ভাজপাকে ‘খামোশ’ বলেছেন। কেন ওদের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়, ব্যাখ্যা করেছেন। তারপর দল ছেড়েছেন। উনি যদি তৃণমূলে আসেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে ওঁর যথেষ্ট আগ্রহও আছে। তবে তার পিছনে শুধু যুক্তি, তর্ক, রাজনৈতিক অবস্থানগত পছন্দই কাজ করছে তা নয়, অবশ্যই অনেকটাই মমতা’র নেতৃত্ব সম্পর্কে ইমোশন কাজ করছে। ইমোশন না থাকলে আবার রাজনীতি করা যায় নাকি!
৩. আমার সঙ্গে ওঁর আধঘণ্টা কথা হল আজ। উনি বললেন, একটা অসম লড়াই চলছিল। একদিকে লোক লস্কর,যাবতীয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি এবং বিপুল ধনশক্তি। উল্টোদিকে বাংলার রয়্যালবেঙ্গল টাইগার হুইল চেয়ারে বসেও শুধু উন্নয়ন ও মানুষের ভালবাসার ওপর ভর করে জনশক্তি কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছেন। সারা দেশে প্রমাণ হয়েছে বিভাজনের নেতা, স্বৈরতন্ত্রের নেতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নেতা নরেন্দ্র মোদিকে পরাস্ত করেছেন নেত্রী মমতাজি। উনি শুধু আর বাংলার নেত্রী নন, উনি গোটা দেশের নেত্রী। যুদ্ধ যদি ন্যায়ের হয়, তবে সে যুদ্ধে অন্যায়ের পক্ষে যতই শক্তি, হুঙ্কার জড়ো হোক, ন্যায়ই জিতবে। এটা অনিবার্য এবং অবধারিত। মাননীয় নরেন্দ্র মোদির কাছে সারা দেশে এখন একটাই থ্রেট, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রিয় ব্যক্তি ও দলের উচিত বাংলার বাঘিনী মমতাকে সমর্থন করা। ওঁর লড়াইয়ের পদ্ধতি ও প্রকরণকে মডেল হিসেবে মেনে নেওয়া। যে টিম মমতা তৈরি করেছেন, যেভাবে এবারের পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তরুণ ব্রিগেডের নেতা অভিষেক লড়াইকে সংহত করেছেন, তা দেশের প্রতিটি মানুষ আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন। আমার বিশ্বাস, পরিণত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ যশবন্ত সিনহা অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ওঁর অভিজ্ঞতা ও ভূমিকাকে তৃণমূল নেতৃত্ব নিশ্চই ব্যবহার করব।
8. শত্রুঘ্ন বললেন,আমি রাজনৈতিক নেতা নই। ভারতীয় রাজনীতিতে অনাচারের বিরুদ্ধে আমি এক সৈনিক হিসেবে কাজ করতে চাই। সেটাই চেষ্টা করে এসেছি। আমি তৃণমূলে (Trinamool) যোগ দিচ্ছি কি না সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল বাংলার বাঘিনী মমতার লড়াইকে মনেপ্রাণে সমর্থন করতে পারছি।
৫. ১২ জুলাইয়ের পরে আজ ১৩ মার্চ ঠিক ৮ মাস সম্পূর্ণ। ২ দিন আগে উত্তরপ্রদেশ সহ ৪ রাজ্যে জিতে ভাজপার জয় শ্রীরাম বাহিনী বেশ উত্তেজিত। ঠিক সেই দুঃসময়ে, অথবা সঙ্কট সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে (দক্ষিণ ভারত বাদ দিয়ে) রাজনীতিতে আসা যাবতীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে সবচেয়ে পরিণত ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব শত্রুঘ্ন তৃণমূলে যোগ দিয়ে আসানসোল (Asansol) লোকসভার কঠিন সিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজী হলেন। আমি আজ ১৩ মার্চ দায়িত্ব নিয়ে বলছি শত্রুঘ্ন জিতবেন।