Last Updated on May 29, 2023 8:17 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন।সৌগত সরকার। আফওয়া। অর্থ, গুজব। বা রিউমার অর্থাৎ যা সত্যি নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এক ক্লিকে নিয়ে আসতে পারে সামাজিক প্রলয়। ভরপেট নাও খাই, ফেসবুক করা চাই। একটা গুজব বা সুপরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবহুল মেসেজ মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে বিশ্বাসের ভিতে। আনসারীর বাড়িতে তলোয়ার হাতে গো মাংস খুঁজতে ঢুকে পড়তে পারে পড়শী রাম। কিংবা একটা ক্লিকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে আদিবাসীদের মধ্যে দাঙ্গা, একটি সাধারন মেয়ে হয়ে উঠতে পারে চরিত্রহীন। অত্যন্ত অবিশ্বাস এবং অসহিষ্ণুতার এই সময়ে পরিচালক সুধীর মিশ্রর আফওয়া অতি গুরুত্বপূর্ন একটি চলচ্চিত্র। কিছুদিন আগেই দ্যা কেরালা স্টোরির প্রপাগান্ডার গালে সপাটে থাপ্পড়। সুধীর এই ছবির ফিল্ম সার্টিফিকেশন বা সেন্সর জোগাড় করেছেন খুব সুচারু ভাবে।শুধু সত্যি তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এই ছবি প্রপাগান্ডা ছবি নয় বলেই সেন্সর বোর্ড টু শব্দটি করতে পারেনি। মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পেলেও নিঃশব্দে চলে গিয়েছে হল থেকে, কিন্তু প্রচুর ধাক্কা ছেড়ে গেল আমাদের জন্য।

রাহাব (নওয়াজউদ্দিন) রাজস্থানের ছেলে হলেও দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিল এবং সফল একজন মানুষ। তাঁর মোটিভেশনাল স্পিচ শোনার জন্য টিকিট কেটে মানুষ হলে আসে। গ্রামের বাড়িতে আসার যাত্রা থেকে এই গল্পের শুরু। মূল উদ্দেশ্য তার লেখক স্ত্রীর বই মুক্তি অনুষ্ঠানে নাহারগড় কেল্লায় হাজির হাওয়া। সুধীরের ইস রাত কি সুভা নেহির মতোই একটা রাত ওলোট পালট করে দেয়।। আপাদমস্তক এই রাজনৈতিক থ্রিলার আমাদেরও তেমন তাড়া করে ছবির একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকেই। রাজস্থানে রাষ্ট্রীয় বিকাশ দলের জুলুস বের হয়, নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ,কিন্তু দরকার একটা স্ফুলিঙ্গের। সেটা অবশ্যই উগ্র ধর্মীয় মেরুকরণ হতেই হবে। সেই মত রাষ্ট্রীয় বিকাশ দলের বর্তমান তরুণ লিডার ভিকি বানা (সুমিত ভ্যাস) র্যালি করার জন্য বেছে নেয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কসাই পট্টি। পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্ল্যান অনুযায়ী তার খাস মাসেলম্যান ও সঙ্গী চন্দন সিং (শারিব হাশমি) মিছিলে পাথর ছুঁড়ে ক্যাওস তৈরি করে এবং দু পক্ষের মারামারির সুযোগে এক সখ্যালঘু কসাইকে হত্যা করে।

এদিকে ভিকি বানার বাগদত্তা এবং রাষ্ট্রীয় বিকাশ দলের সুপ্রিমোর মেয়ে নিবেদিতা সিং (ভূমি পেডনেকর) তীব্র প্রতিবাদ করে এই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ঘটনায়। ভিকি বানার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে পরে। একদিকে ভিকির সমর্থকরা নেতার হবু বউকে খুঁজতে ছড়িয়ে পড়ে অন্যদিকে চন্দনকে সরিয়ে দায়মুক্ত হতে ভিকি ইন্সপেক্টর তোমরকে নির্দেশ দেয়। রাস্তায় একটি মেয়েকে হাতধরে টানাটানি করতে দেখে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাহাব। কোনও রকমে তাকে বাঁচিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় সে। আর নিজের সন্মান বাঁচাতে পার্টির আইটি ডিপার্টমেন্টকে ব্যবহার করে ভিকি। মুহূর্তে রাজস্থানের শাওয়ালপুর অঞ্চলে সকলের ফোনে একটিই ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ল। জেলার একটি মুসলিম ছেলে, রাহাব আহমেদ, ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। অতএব, লাভজিহাদ। মিলিয়ন-বিলিয়ন শেয়ার। এক নম্বরে ট্রেন্ডিং। আর রাজনৈতিক ফায়দা হল, যেন এই লাভজিহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছে সাওয়ালপুরের উঠতি নেতা, ভিকি সিং,নিবেদিতার বাগদত্তা।
মানুষ অনায়াসে তা বিশ্বাস করতে থেকে। শুরু হয় এক অসম পলায়ন,আর রাজ্য জুড়ে দাঙ্গা। অথচ রাহাব এবং নিবেদিতা— একে অন্যের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। নিবেদিতা এবং রাহাবের চেনা সাওয়ালপুর ততই বদলে যায়।সুধীরের ছবি যত এগোয় রাত গভীর হয়, বাড়তে থাকে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ,সন্দেহ আর ঘৃণা। অপরাধী চন্দন বেচেঁ যায় এবং ক্রমশ বুঝতে পারে ভিকি তাকে সরিয়ে কলঙ্কমুক্ত হতে চাইছে। আহত নিবেদিতা ও এই উটকো ঝামেলায় ফেঁসে যাওয়া রাহাবকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, কোনও রকমে মেহেরগড় কেল্লায় পৌঁছে দিতে চায়। কৌশল বদলায় ভিকি। এবার তাদের ট্রাকের ছবি ভাইরাল করে লেখা হয়, বেআইনি ভাবে গো মাতা পাচার করছে এক বিধর্মী,যে লাভ জিহাদ করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে ভিকির হিন্দু হবু স্ত্রীকে। জেলার পর জেলা ছড়িয়ে পরে সেই পোস্ট।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এবার নেমে পরে ময়দানে এই লাভ জিহাদী এবং গরু পাচারকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। কোনও রকমে কেল্লায় পৌঁছালেও নিরাপত্তার কারণে কেল্লার দরজা খোলে না আয়োজকরা। কেল্লার ভিতরে তখন চলছে পারফর্মিং আর্ট, তীব্র নাচের,আলোর জৌলুস। আর ছুরিবিদ্ধ রাহাব রক্তাক্ত। অন্যদিকে ভিকি এসে পৌঁছয়। ওই ট্রাকে করেই নিবেদিতাকে নিয়ে রওনা দেয়। পথ আটকায় অন্য জেলার উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। নিবেদিতা ভিকিকে চরম শিক্ষা দিতে তাদের সামনেই ভিকিকে জড়িয়ে ধরে। উত্তেজিত ধর্মান্ধ অস্ত্রধারীরা ভিকিকেই লাভ জিহাদী সংখ্যালঘু মনে করে। নিজের পাতা ধর্মের রাজনীতির ফাঁদে ভিকির মৃত্যু হয়। পুলিশ গরু ভর্তি ট্রাকের ডালা খুললে লাইন করে বেরিয়ে আসে গাধার দল।
তীব্র রাজনৈতিক এই ছবি এই সময়ের ভারতবর্ষের ছবি এঁকেছে। পরিচালক আমাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া অসহিষ্ণুতার কারণ হিসাবে রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করেছেন। যেখানে দেশের ২০ কোটি মানুষ দুবেলা এখনও ভরপেট খাবার পায় না, শিক্ষা,চিকিৎসা পৌঁছয়নি ৬০ শতাংশ জায়গায়,সেখানে সবার হাতে স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়াকে অন্ধের মত বিশ্বাস আসলে আমাদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসকেই বাড়াচ্ছে। অনুভব সিনহার প্রযোজনায় এই ছবিতে কারেল অন্তনিন এর মিউজিক অতি প্রশংসনীয়। থ্রিলার ছবি না হয়েও থ্রিলারের পুরো আবহ এবং এয়ে বসন্ত গানটির থিম হিসাবে বার বার ফিরে আসা এক নতুন ভোরের সন্ধান রেখে যায়।