Last Updated on May 23, 2023 7:50 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। মাত্র সাড়ে দশ সেন্টিমিটার লম্বা একটি নারী মূর্তি। বয়সটাও নয় নয় করে প্রায় ৫ হাজার বছর। শিল্প এবং সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের সভ্যতা কতটা প্রাচীন গোটা পৃথিবীর দরবারে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করার জন্য এই সাড়ে দশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের নারী মূর্তি সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য। তবে সাড়ে ১০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের ব্রোঞ্জের তৈরি এই নারী মূর্তি সম্পূর্ণ নগ্ন।
সেই কারণেই হয়তো বিশ্বের দরবারে ভারতীয় শিল্পসাহিত্যের গরিমাকে পৌঁছে দেওয়া ছোট্ট এই নারী মূর্তিকে রঙের প্রলেপে যেন ফেয়ার এন্ড লাভলী মাখিয়ে গৌর বর্ণা করে পোশাকে সজ্জিত করে তুলল মোদি সরকার। দিল্লিতে মিউজিয়াম দিবস উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম এক্সপোতে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রিমোট কন্ট্রোলে ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ম্যাসকট হিসেবে ভারতীয় সভ্যতার এবং শিল্পের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন নিদর্শন মহেঞ্জোদারোর নগ্ন নর্তকী মূর্তির উদঘাটন করার পরেই দেখা গেল পাঁচ হাজার বছরের পুরনো মহেঞ্জোদাড়োর নর্তকীকে ফ্যাশন প্যারেডের জন্য শো-কেস করেছে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক।

কি তাৎপর্য মহেঞ্জোদারোর নর্তকীর
সিন্ধু সভ্যতার অনেক অংশ এখন ভারতে, যদিও আবিষ্কার যেখান থেকে শুরু সেই মহেঞ্জোদাড়ো এবং হরপ্পা দেশভাগের পরে পাকিস্তানে। সিন্ধু সভ্যতার রহস্যের পরতে পরতে অনেক জটিল জট। যেমন, এই নর্তকীর মূর্তি। ১৯২৬ সালে মহেঞ্জোদারোতে ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে সাড়ে দশ সেন্টিমিটার লম্বা ব্রোঞ্জের ছোট্ট এক মূর্তি খুঁজে পান দয়ারাম সাহানি।
দৃপ্ত উন্নত মস্তক এই মেয়ের। বালুচি শৈলীর ছাঁচে ঢালা অপরূপ মুখশ্রী। স্ফুরিত ওষ্ঠযুগল, পিছনে সামান্য হেলানো মাথা, প্রশস্ত নাক, বাঁকানো চিবুক, কোঁকড়ানো গোছা গোছা চুল, চওড়া কপাল, অহঙ্কারী দৃষ্টি তার বড় বড় দু’চোখে। তার নিরাবরণ দেহশৈলীর অনুপম বর্ণনা আছে মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক জন মার্শালের লেখায়। বাঁ হাতে পঁচিশটির মতো চুড়ি, কব্জি থেকে কাঁধ পর্যন্ত সাজানো। থর মরু-অঞ্চলের রমণীদের মতো। সে হাত বাঁকানো, ছোট্ট একটি বাটি ধরা। অর্ধ-লজ্জাহীন ভঙ্গিতে নিতম্বের উপরে সে হাত। ডান হাতে চারটি চুড়ি। তিনটি বড় পেনডেন্ট দেওয়া একটা নেকলেস তার গলায়। নিরাবরণ দেহে শুধু এটুকুই আভরণ। সামান্য এগনো বাঁ পা হাঁটু থেকে অল্প ভাঁজ করা। তার শরীরের বিভঙ্গে প্রাচীন নৃত্য ও নাট্যশৈলীর প্রকাশ খুঁজে পেয়েছেন সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ববিদরা। আর তাই তাকে নৃত্যশিল্পী হিসেবেই মেনে নিয়েছিল দুনিয়া। যদিও ইতিহাসের পণ্ডিত্যের মধ্যে এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই আজও।
কেন পোশাকে আচ্ছাদিত নগ্ন নর্তকী
ভারতে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় প্রাচীন শিল্পকলা – তা সে খাজুরাহর মন্দির হোক অথবা কোনারকের সূর্য মন্দির, আবার জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত প্রাচীন যাবতীয় স্থাপত্য ের প্রত্যেকটিতেই শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে নগ্নতার আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পীরা। যদিও মানব শরীরকে দেবতা জ্ঞানে শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়, ইউরোপের শিল্পী রাও বরাবর আশ্রয় নিয়েছেন নগ্নতার। কিন্তু ও অদ্ভুতভাবে পরবর্তীকালে ধর্মীয় মৌলবাদীরা শিল্পের মর্যাদা না বুঝে সেই নগ্নতাকে কখনো ঢাকতে চেয়েছে নিজেদের পছন্দের পোশাকের আড়ালে আবার কখনো বা ধ্যতের সঙ্গে নিজেদের মৌলবাদী মানসিকতাকে সকলের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে ভেঙে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে শিল্পের মহান নিদর্শনগুলিকে।
ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে শিল্পকলা নিশ্চিহ্ন হওয়ার নিদর্শন যেমন বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে তালিবান জঙ্গীরা দেখিয়েছিল ঠিক তেমনি সিরিয়ার আয়ু শেষ জঙ্গিরা মেসর ও মেশোপটেমিও সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন সিরিয়ার বুক থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ড়িয়ে দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে লজ্জার নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
পিছিয়ে নেই আমাদের ভারত বর্ষ। ভারতীয় শিল্পের উপরে বারে বারে আঘাত নেমে এসেছে মৌলবাদী শাসকদের তালিবানি ফতোয়ায়। তার উপরে যদি সেই শিল্পী নারী শরীরের সঙ্গে নগ্নতার কোন সম্পর্ক থাকে তাহলে তো রে রে করে মাঠে নেমে পড়তে শুরু করে উগ্র মৌলবাদীরা। ঠিক যেভাবে হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার বা আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মহেঞ্জোদারো নগ্ন নারী মূর্তি নগ্ন দেখে তাকে পোশাক পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মোদি সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা, তার মধ্যে অবশ্য রয়েছে আর এক ধরনের উগ্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফোলানোর উদগ্র বাসনা।
ইতিহাস বদলানোর ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টা
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রে ভাজপা সরকার গঠন করার পর থেকে ভারতের ইতিহাস থেকে মুসলিম শাসক বা মোঘলদের ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার জন্য ইতিহাসবিদদের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মহেঞ্জোদারো নগ্ন নর্তকিকে পোশাক পরিয়ে বিশ্বের সামনে উপস্থিত করা ভারতের প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করে নতুন করে রচনা করা বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা বলেই মনে করছেন দেশের বহু নৃতত্ববিদ এবং ইতিহাসবিদরা।