নাস্তিকের অধিকার

0

Last Updated on October 16, 2021 11:58 PM by Khabar365Din

পূষন গুপ্ত


১.

ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আইআইটি খড়্গপুর করোনা পরবর্তী ২০২১ সালে প্রাক পুজো পিরিয়ড়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা প্রকাশ করে। এই সমীক্ষা বাংলার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর অর্থনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে। এই ধরণের সমীক্ষা আগেও হয়েছে, বণিকসভার পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এবারের সমীক্ষা যদিও করোনা পূর্ববর্তী ২০১৯ সালের বাংলার পুজোকে ধরে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শুধু এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে ৩২, ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয় এবং জাত-ধর্ম নির্বিশেষে ২ কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়। এই সব কর্মীদের মধ্যে আছেন থিম এ ভাবনার পরিচালক, প্রতিমা শিল্পী, মন্ডপ শিল্পী, আলোক শিল্পী, মণ্ডপসজ্জায় জড়িত বাংলার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের লোকশিল্পী, খাবার ও পানীয় সরবরাহকারী, মণ্ডপকে কেন্দ্র করে ছোট-বড় বিভিন্ন পণ্য, বিশেষত খাদ্যের দোকান। এর বাইরে সংগঠিত ও অসংগঠিত বাজার (শপিং মলের ব্র্যান্ডেড শপ থেকে ফুটপাথ ব্যাপারি), পরিবহণ ও অসংখ্য দিনমজুর। এই সমীক্ষাগুলিতে আরও বলা হয়েছে, থিম পুজোর রমরমা যত বেড়েছে, তত বিনিয়োগ বেড়েছে, কেননা ভিড় বেড়েছে, ফলে স্পনসরশিপ ও ব্র্যান্ডিং কয়েক শো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বাংলার টাটা, বিড়লা, আম্বানি, আদানি, ইনফোসিস-কেউই প্রতি বছর করে না। তাদের পায়ে ধরে ডেকে এনে বিনামূল্যে চাষের জমিও দিতে হচ্ছে না। কৃষিকে সর্বনাশের পথে ঠেলে, শিল্পায়নের ভাঁওতাবাজি দেওয়া সিপিএমীয় মিথ্যাচার করতে হচ্ছে না। বছর দশ-এগারো ধরে এই বিপুল বিনিয়োগকে এবং বিনিয়োগের মূল উৎস বাংলার থিম পুজোকে যারা বিল্প করে, রসিকতা করে, আক্রমণ করে তারা শুধু মূর্খ নয়, গণশত্রুও বটে। আমি অবশ্যই বাংলানা যে কোনও ধরণের বিনিয়োগের পক্ষে, যেমন থিম পুজোর মাধ্যমে হতে পারে, তেমন প্রোমোটারির মাধ্যমে হলেও আমার সমান উৎসাহ আছে।

২.

তারপরেও কিছু কথা আছে, এবার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে। বস্তুত শুধু আমার নয়, ব্যক্তি মতামত লেখার জন্য সংবাদপত্র নয়, সমমনস্ক অনেকেই আমার মতো একই কথা ভাবছেন। সিপিএমের একটা মস্ত বড় সুবিধা ছিল, দীর্ঘদিন তাদের কোনও প্রতিপক্ষ ছিল না। তাদের সময়ে নকশাল নেই, তাদের সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁট এসইউসিআই মাঝে মাঝে চিমটি কাটে বটে, তাদের পিটিয়ে ছালচামড়া তুলে দিলেই হল, আর গোলমেলে মাওবাদী এলাকায় বিশেষ না গেলেই ঝামেলা খতম। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছিলেন একজনই, তিনি মমতা। সিপিএমকে তিনি একাই বাংলা থেকে মুছে দিতে সমর্থ হয়েছেন। সিপিএমের আমলে উঠোনে ধর্মের বাঘ ঘুরে বেড়াত না, ভাজপা ছিল না। ভাজপার মতো ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক এলিমেন্ট গোটা বিশ্বে হিটলার বা জ্বালিনের পর আর আসেনি, উগ্র হিন্দুত্বে এরা কয়েক বছর আগেও গোটা দেশকে গ্রাস করে নিয়েছিল। এদের প্রতিরোধ করার যেসব রাজনৈতিক ও সামাজিক কৌশল আছে, তার মধ্যে অবশ্যই একটি সফট ধর্মীয় আচরণ। সফট বার্মিকতা আচেতন জনগণকে উগ্র ধার্মিকতার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সাহায্য করে আর অনেকটাই ধার্মিকতার শাস্ত্রীয় আচার-আচরণের বদলে উৎসবমুখী করে তোলে। অর্থাৎ সহজ বাংলায়, ধর্মের থেকে ধর্মকে কেন্দ্র করে স্নাত-ধর্ম নির্বিশেষে উৎসবটাই আসল।

৩.

কেউ কেউ বলবেন, এই সুযোগে আমি জর্জ লুকাচের থিওরি কপচাচ্ছি। আজ্ঞে না। আমি এক বিপজ্জনক প্রবণতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ধর্মকেন্দ্রিক (এক্ষেত্রে দুর্গাপুজো) উৎসব পোস্টকরোনা পিরিয়ডে, প্রায় সেই ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমার অমোঘ দৃশ্য, সেই ‘মামা ভয়ঙ্কর আমোদ এর দিকে ধীর পায়ে এগোচ্ছে। মাঝরাত পর্যন্ত সংবাদপত্রের বুলেটিন করে ঘুমোতে যাওয়ার পর, ভোর চারটেয় ঢাকিরা তারস্বরে (এই শব্দটিই ব্যবহার করব, কর্কশ আওয়াজে মাত্র) আবাসন কমপ্লেক্স প্রদক্ষিণ করছে, কেন কে জানে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে শুরু হচ্ছে দীর্ঘ, যতিচিহ্নহীন, অকারণ মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষায় অশিক্ষাজনিত অসহা ভূল। নির্দিষ্ট সময়ে পুজো মণ্ডপে পুষ্পাঞ্জলি হোক, নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকের বাদ্যি বাজুক, কোনও একদিন ঢাকেনা প্রতিযোগিতাও হোক- কোনও আপত্তি নেই। আজ সকালে যখন তারা ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে ঢাকের বোল বাজিয়ে বকশিশ চাইল, তখন খুশি মনে দিলাম। আমার বিরক্তি বুঝতে দিইনি কারণ সমস্যাটা তারা তৈরি করছেন না। তৈরি করছেন সফট ধার্মিকতায় পুষ্ট অতি উৎসাহী উদ্যোক্তারা। কখনও লেজার বিমের আলো ছুঁড়ে বিমান চলাচলে বাধা তৈরি করছেন, কখনও অস্বাভাবিক ভিড় তৈরির জন্য ৩০০ ফুটের দুর্গা, হাজার ফুটের অসুর, পিরামিড বা বুঝ খলিফা বানাচ্ছেন। যার সঙ্গে থিম পুজোর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, যার সঙ্গে দেশজ শিল্প সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নেই, কোনও ভাবনা চিন্তা নেই, কোনও শিক্ষার ছাপ নেই, কোনও সূক্ষ্ম সচেতনতা নেই। কেউ বিমানবন্দরে পৌঁছতে পারল কিনা, কী এসে গোল। কেউ স্টেশনে নামতে পারল কিনা, কী এসে গেল। কারোর সারারাত ঘুম ভেঙে থাকতে হল, তাতে কী এসে গেল। বাচ্চরকার দিন, ওরকম একটু আটু হবে। পুজোর কদিন একটু মেনে নিতে হবে। একটু অ্যাডজাস্ট করুন দাদা। আপনি অগুলি দেন না তো কী, বেশিরভাগ লোকই দেয় নাদা। আপনার এই সমাজে থাকার অধিকারনেই কেটে পড়ুন।

৪.

শাহরুখ খান বা মকবুল ফিদা বসেন যত বড় শিল্পীই হন, এঁরা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুদের সমাজে ওদের হয় মেনে নিতে হবে, নয় দেশ ছেড়ে কেটে পড়ে দুবাইয়ে গিয়ে থাকতে হবে। আপনি নাস্তিক বা এথিস্ট বা নিরীশ্বরবাদী বা সংশয়বাদী মানে আপনি সংখ্যালঘু, আপনি অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি দেন না বলে আপনি সংখ্যালঘু। আপনি দশমীতে সিঁদুর খেলেন না বলে আপনি সংখ্যালঘু। আপনি বিজয়ার পর কোলাকুলি করেন না বলে আপনি সংখ্যালঘু। আপনি বেজাত, আপনি হিন্দু সংখ্যালঘু সমাজে চলার অনুপযুক্ত। আপনি পাবলিক ইমোশন বোনে না। আপনি মানুষের সেন্টিমেন্ট বোঝেন না। আপনি আঁতেল এবং আপনি গণশত্রু। আপনি আমাদের হাউজিং ছেড়ে, আমাদের পাড়া ছেড়ে বরং দুবাইয়ে গিয়ে থাকুন। কম্প্রোমাইজ করতে শিখুন, নইলে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।

৫.

আমি বা আমার মতো সমমনস্করা কখনই বৃহত্তর সমাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকি না। ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের বিপুল আবেগ ও উৎসাহ। পুজো হিসেবে নয়, উৎসব হিসেবে। সনাতন দিন্দা, ভবতোষ সুতার, রূপচাঁদ কুণ্ডু, সুনীলবাবু বা আমার বন্ধু আর্ট ডিরেক্টর তন্ময় কী ধরণের প্রতিমা বানাচ্ছে, তা জানার জন্য গোলেদা রিপোর্টারকে লাগাই। সবার আগে ছবি ছাপি। গত ৩ বছর ধরে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলের সেরা থিম পুজোকে মাঝাও পাখির পালকের আদলে তৈরি টুফি ও অর্থমূল্য দিয়ে ‘পল্লীসম্মান’ পুরস্কার দিচ্ছি। পুরস্কার কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দেশের তাবড় শিল্পীরা। বাউল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ফোক পপ শিল্পাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে কার্নিভাল করছি। সবকিছু কিন্তু দুর্গাপুজোকে ঘিরেই। কোথাও কোনও তঞ্চকতা নেই। কোথাও কোনও বিরোধ নেই।

৬.

ভোর চারটেয় কেন ঢাকিদের ঢাক বেজে ওঠে তা অধিকাংশ উদ্যোক্তারা না জানলেও আমি জানি। বাংলার লোকায়ত যারা অনুযায়ী সপ্তমীর সূর্যোদয়ের অধিক পূর্বে ঢাকিরা মন্ডপে প্রবেশ করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। তাই অত ভোরে। তা বলে পুজোর প্রতিদিন নয়। মুশকিল হল, অধিকাংশ উদ্যোক্তাদের থেকে শাস্ত্রটাও আমি ও আমার সমমনস্কদের কিঞ্চিৎ বেশি পড়া আছে।

৭.

আমার মতো নাস্তিক বা এথিস্ট বা নিরীশ্বরবাদী বা সংশয়বাদীরা কালাপাহাড় নন। তোমার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই বলে বিশ্বাসীদের আক্রমণ করবে-এটা ঘৃণ্য ফাসিও কায়লা। তোমার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই বলে, তুমি ঠাকুরঘরে বুটজুতো পরে ঢুকতে পার না, তোমার সেই অধিকার নেই। কারোর ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করার অধিকার সমাজ বা সংবিধান তোমাকে দেয়নি। তেমনই একইভাবে নাস্তিকের অধিকারকে সংখ্যাগুরুরা কেড়ে নিতে পারে না। সংবিধান বলে, সভ্য সমাজ বলে, সংখ্যাগুরুর অধিকারের পাশাপাশি সংখ্যালঘুর ও সমানাধিকার। জোর করে শুনতে, দেখতে যা বলতে হবে অর্থাৎ মনের ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য করা হবে, এটা কোনও সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। উত্তেজিত উদ্যোক্তাদের উৎসাহ তথা স্বআরোপিত্র সেন্টিমেন্ট যে হারে বাড়ছে, তাতে আমার মতো নাস্তিক বা এঘিস্ট বা নিরীশ্বরবাদী বা সংশয়বাদীর অদুর ভবিষ্যতে শঙ্কার কারণ আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here