Last Updated on February 14, 2022 11:52 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। ৪ পুরনির্বাচনেই জয়ী হল তৃণমূল। তবে কলকাতা পুরভোটে সামান্য হলেও ফিরে আসার যে আশা জাগিয়েছিল বামেরা, বিধাননগর এবং শিলিগুড়ি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে বাংলায় কার্যত রাজনৈতিক অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। অন্যদিকে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিধান নগর থেকে ভাজপা প্রার্থী হিসেবে সব্যসাচী দত্ত হেরে গেলেও পুর নির্বাচনে জয় পেলেন স্বমহিমায়। কারণ একুশের নির্বাচনে ভাজপা প্রার্থী হিসেবে সব্যসাচী দত্তর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিধাননগরের বাঙালি ভোটাররা। এবারে তৃণমূলে ফিরে আসায় সব্যসাচী দত্তর ভোটবাক্সে ফিরে এসেছে সেই বাঙালি ভোট।
যে সল্টলেক এবং নিউটাউনের একাংশ এবারে রেকর্ড ভোটে জয়ী করেছে তৃণমূল প্রার্থীদের সেগুলোই মাত্র বছর কয়েক আগে পর্যন্ত বাংলায় লাল দুর্গের তকমা পেত। আবার ২০১১ সালে প্রবল তৃণমূল ঝড়ের মধ্যে মমতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্বেও যেখানে শিলিগুড়ি পুরসভার ২০১৫ সালের নির্বাচনে নিজেদের দখলে রেখেছিল সিপিএম, সেখানেও মমতাকে হারানোর জন্য ভাজপার সঙ্গে আঁতাত করতে গিয়ে গোহারান হারলো সিপিএমও। এমনকি বাংলায় বাম-রাম থিওরির জনক অশোক ভট্টাচার্যকে এবারের পুরভোটে দলের মুখ করে নামিয়েছিল সিপিএম তিনিও লজ্জাজনকভাবে হারলেন নিজের পাড়াতেই। তবে শিলিগুড়িতে গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই সিপিএম এবং ভাজপা এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল যে এখনো টিকে থাকা গুটিকয়েক সিপিএম সমর্থক কে আসল সিপিএম প্রার্থী আর কে ভাজপা প্রার্থী বুঝে উঠতে না পেরে সিপিএম ভেবে ভাজপাকেও ভোট দিলেন। যার ফলে শিলিগুড়িতে সিপিএমের আসন নেমে দাঁড়ালো ৪।
অন্যদিকে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ভাজপা যে তুমুল প্রচার চালিয়েছিল বাংলা জুড়ে তারাও বিধান নগর থেকে শুরু করে চন্দননগর আসানসোল সর্বত্র অধিকাংশ আসনে জামানত খুইয়ে ধিকিধিকি করে জ্বলে থাকলো উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি পুরসভায়। এখন কার্যত ভাজপা উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেল ক্ষমতার অথবা আসনের ভিত্তিতে। যদিও এককালের আরেক লাল দুর্গ বলে পরিচিত আসানসোল পুরসভাতেও সিপিএম কার্যত মুছে গেলেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখল ভাজপা।
বিধাননগর
বাম শূন্য
বিধানসভা বির্বাচনের পরে রাজ্যের মানুষের মনভাব বুঝে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক দল গুলিও। সেই কারণে এবারের পুরভোটে বিধাননগরে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় পরিচিত মুখ প্রায় কেউই ছিল না। ফল হিসাবে হাতেনাতে বিজেপির বাংলায় অবস্থা বুঝিয়ে ছিল মানুষ। কারণ বিধাননগরের ভোটে কেবল মাত্র তিনটি ওয়ার্ডে অর্থাৎ ৪০ এবং ৪১ এবং ৩৬ এ বিজেপিকে বিরোধী দল হিসাবে দেখা গেল। কিন্তু সেখানেও ৪০ জমানত জব্দ হল বিজেপি। সেখানে তাদের প্রাপ্ত ভোট ২৭১। জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী তুলসী সিনহা রায়। অন্যদিকে এই নির্বাচনে সব থেকে বেশী ভোটে জয় লাভ করেছে তাপস চ্যাটার্জীর কণ্যা অরিত্রিকা ভট্টাচার্য। তিনি মোটা ভোট পেয়েছেন ১০ হাজার ৬০৮ টি। জয়ের ব্যাবধান ১০ হাজার ৩৪১।সেখানে বিরোধী হিসাবে উঠে এসেছে সিপিআইএম। তাদেও জমানা জব্দ হয়েছে। প্রাপ্ত ভোট ২৬৮। শুধু তাই নয় শাহনওয়াজ আলি মন্ডল ওরফে ডাম্পিও দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ তাঁকে ছাড়া কাউকেই মানছেন না। এবারের নির্বাচনে ফলাফলে তার প্রাপ্ত ভোট ১০হাজার ৭১৮ টি।জয়ের ব্যবধান ১০ হাজার ২০০। প্রধান বিরোধী দল জমানত জব্দ হয়ে গিয়েও সিপিআইএম। তাদের প্রাপ্ত ভোট ৫২০। মোট ৪১ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯ টি ওয়ার্ডে সবুজ ঝড়ে উড়ে গিয়েছে বিরোধীরা। তবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেসের গীতা সর্দার। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৪২৪ টি। জয়ের ব্যবধান ৩৫৭৮। এই নিয়ে টানা ৪১ বছর এই ওয়ার্ডটি কংগ্রেসের দখলেই রয়ে গেল। নজর কেড়ে এবারে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলরের পরিবারের সদস্যা। তিনি ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৩৩। জয়ের ব্যবধান ১১৪৮। এবারে আজিজুল দলের টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই টিকিটেই নির্দল হিসাবে জয় লাভ করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে ৪১টির মধ্যে ৪০ টিতেই তৃণমূলেরই জয় হয়েছে। আগামীতে ১২ নম্বরও ওয়ার্ডটির প্রার্থীও তৃণমূলে যোগদান করার সম্ভাবনা নির্বাচনের আগেই কার্যত ঘোষনা হয়েছিল। ফলে বিধাননগরের নির্বাচনে আগামী দিনে ফলাফল সামান্য পরিবর্তন হয়ে ৪০ টি ওয়ার্ড দখলে রাখতে চলেছে। সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে বিজেপি বিধাননগরে ৩৭ টি ওয়ার্ডে তাদের জমানত জব্দ করিয়েছে। আর সিপিএম লড়াই দিলেও একাধিক ওয়ার্ডে জমানত জব্দ করিয়েছে।
শিলিগুড়ি
অশোকও হারলেন
শিলিগুড়িতে মুছে গেল সিপি আইএম। কোণঠাসা হয়েও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলো বিজেপি। কলকাতা থেকেই গৌতম দেবকে শিলিগুড়ি পুরনিগমের মেয়র ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।শিলিগুড়ি পুরো নিগমের ৪৭ টি আসনের ৩৭টিতে জয় তৃনমূল। ৪৫বছরের ইতিহাস ভেঙে গণজোয়ারে ভাসছে তৃনমূল। মানুষের রায়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শিলিগুড়ি পুরনিগমের বোর্ড গঠন করতে চলেছে তৃনমূল। কংগ্রেস বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে চলা অশোক মডেল প্রত্যাখ্যান শিলিগুড়িবাসীর। বামেদের শিলিগুড়ি মডেল ভেঙে খান খান!বামেদের চির বিদায় জানিয়ে দিলো শহরবাসী।ভরাডুবি গুরু শিষ্য অশোক ও শঙ্কর ঘোষের। সোমবার শিলিগুড়ি কলেজের ভোট গণনা কেন্দ্রে প্রথম রাউন্ড শেষেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় তৃণমূলের জয়। ৩৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৬টিতে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষ শিবিরকে পরাজিত করে জোড়া ফুল শিবির। তৃনমূলের হেভিওয়েট তিন প্রার্থী গৌতম দেব, রঞ্জন সরকার ও কুন্তল রায় সহ ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়যুক্ত হন। শিলিগুড়ি পুরনিগমের ৩৩নাম্বার ওয়ার্ডে ৩৪০০ভোটের রেকর্ড ব্যবধানে জয়যুক্ত হন গৌতম দেব। ১৫ নাম্বার ওয়ার্ডে ১৪০০ভোটে জয় হাসিল করেন রঞ্জন সরকার।ছয় নাম্বার ওয়ার্ডে প্রাক্তন মেয়র-কাউন্সিলর অশোক ভট্টাচার্যকে ৫৫০ভোটে পরাজিত করে তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আলম ঘাস ফুল ফোটান। এদিকে শিলিগুড়ি পুরো নিগমের বিজেপি বিধায়কের ওয়ার্ডে মানুষের রায়ের নিরীখে একেবারে চতুর্থ স্থানে নেমে যান বিধায়ক শংকর।এদিন জয়ের পর শিলিগুড়ি পুরো নিগমের গৌতম দেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গেয়ে আবেগ উদবেলিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিলিগুড়ি উন্নয়নের রোড ম্যাপ তৈরি করে রেখেছেন। সেই সেইমতো কাজ করা হবে। এদিকে শিলিগুড়ির রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন আজই বিরোধীদের সঙ্গে দেখা করে সৌজন্য বিনিময় করবো। এদিনই কলকাতা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিলিগুড়ি পুরো নিগমের মেয়র হিসেবে গৌতম দেবের নাম ঘোষণা করেন। অন্যদিকে এই বিপুল জয়কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করতে চায় দার্জিলিং জেলা তৃণমূল। সোমবার বিকেলেই শিলিগুড়ির মাটিতে পৌঁছে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে তাকে ঘিরে বিজয় উল্লাস এক ভিন্ন মাত্রা নেবে। পাশাপাশি সকাল দশটা থেকেই শিলিগুড়ির রাজপথে তৃণমূলের সমর্থনে আপামর জনসাধারণের ঢল নামে। ঢাক ব্যান্ড পার্টি নিয়ে সবুজ আবির উড়িয়ে মিষ্টি বিতরনের মধ্য দিয়ে বিজয় উল্লাস চলে।
চন্দননগর
ভাজপা নেই
চন্দননগর পুরনিগমে নিরঙ্কুশ জয় তৃণমূলের। ৩২ আসনের মধ্যে ৩১ টি গেল তৃণমূলের দখলে। গতবার অর্থাৎ ২০১৫ পুর নির্বাচনে ৮ টি আসন পেলেও এবার টিমটিম করে একটি মাত্র আসন জিতে কোনও ক্রমে অস্তিত্ব জানান দিল বামেরা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ভাজপার। চন্দননগরে খাতাই খুলতে পারল না তারা। গত পুরভোটে একটি আসনে জয় পেয়েছিল তারা। গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে চন্দননগর শিল্পাঞ্চলের একটা বড় অংশ নিয়ে চন্দননগর পুরনিগম। তৃণমূল প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল এই পুরনিগম তারাই দখল করছে। সোমবার ইভিএম খুলতেই কার্যত খড়কুটোর মত উড়ে যায় ভাজপা এবং বামেরা। কংগ্রেস এখানে এমনিতেই সাইনবোর্ড তাই তাদের আগাগোড়া কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। ফলাফলেও তারা চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে অধিকাংশ আসনে। ৩৩ ওয়ার্ডের চন্দননগর পুরনিগমে ভোট হয় ৩২ আসনে। প্রার্থীর মৃত্যুর জন্য একটি আসনে ভোট হয়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩২ আসনের মধ্যে ২৫ আসনে ইতিমধ্যেই জিতে গিয়েছে তৃণমূল। ফলে বোর্ড তারা ইতিমধ্যেই দখল করে ফেলেছে। দ্বিতীয় স্থানে বামেরা। একটি আসন তাদের দখলে গিয়েছে। বেশীরভাগ আসনেই তারা দ্বিতীয়। ভাজপা প্রায় সব আসনেই তৃতীয়। তৃণমূলের দাবি, ৩১ আসন ই তাদের দখলে যাবে শেষ পর্যন্ত। অন্যদিকে, দিলীপ, শুভেন্দু, সুকান্ত, অর্জুন সহ গোটা ভাজপা নেতৃত্বকে প্রচারে নামিয়েও খাতা খুলতে না পেরে দেখা যায় গণনা শেষ হওয়ার আগেই প্রার্থী, এজেন্টরা গণনা কেন্দ্র ছেড়ে লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছেন।
আসানসোল
অবাঙালি ভোটে ৭
আসানসোল পুরনিগমে সবুজ ঝড়। কার্যত সাইনবোর্ডে পরিণত হল বামেরা। মাত্র ২ টি আসনে কোনও রকমে জয় পেল তারা। পকেট ভোট পেয়ে অস্তিত্ব কিছুটা হলেও জানান দিল ভাজপা। তবে তৃণমূলের ধারে কাছে নেই তারা। বিরোধীদের সব অভিযোগ ধুলিস্যাৎ করে মানুষের ভোটে পুনরায় আসানসোল পৌরনিগমে পৌর বোর্ড গঠন করতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই তৃণমূল বোর্ড গঠন করছে। সোমবার সকাল থেকেই যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে সকাল থেকে যেভাবে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে তাতে তৃণমূল দুপুরের আগেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রায় ৬০ টি ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেস জয় পেয়েছে। বিজেপি পেয়েছে ৬ টি বামেরা পেয়েছে ২ টি, কংগ্রেস পেয়েছে ৩ টি, একটি ওয়ার্ড টাই হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বামেদের। ২০১৫ পুরভোটে আসানসোল পুরনিগমে ১৭ আসনে জয় পায় তারা। এবার টিমটিম করে ২ টি আসন ধরে রাখতে পেরেছে তারা। আসানসোল তো বটেই রানীগঞ্জ কুলটির মত এলাকাতেও ভোট পায়নি বামেরা। উল্লেখযোগ্য জয়ীদের মধ্যে তৃণমূলের প্রার্থী অভিজিৎ ঘটক, অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ বসু, উৎপল সিংহরা রয়েছেন। কুলটির বিজেপির প্রভাবশালী বিজেপি নেতা অভিজিৎ আচার্য। তবে গোবরে পদ্মফুল হয়েও খানিকটা হলেও সম্মান বাঁচালেন জিতেনের স্ত্রী চৈতালী তেওয়ারি এবং জিতেন্দ্র অনুগামী গৌরভ গুপ্ত বিজেপি প্রার্থী হয়ে আসানসোল থেকে জয় পেয়েছেন।