Last Updated on June 18, 2022 7:32 PM by Khabar365Din
ঢাকা থেকে ফিরে গৌতম লাহিড়ী
৩৬৫ দিন। না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। একটা সেত গোটা জাতির ভাবাবেগ জাগ্রত করে দিয়েছে। আমাজনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মা। সেই নদীর উপরে নির্মিত সেতু। এ যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ জয় বাঙালির। বাংলাদেশের। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্ম মর্যাদার লড়াই ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাস্ত করেছিল প্রবল শক্তিমান তখনকার পাকিস্তানকে। ৫১ বছর পরে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে পদ্মা নদীর উপর সেত নির্মাণ করালেন। নিজের জোরে। বাংলাদেশের মানুষের অকৃপণ যোগদানে আজ সেই স্বপ্ন সত্য।। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রাণ সঞ্চার হলো তার সুফল পাবে আগামী প্রজন্ম। আত্মনির্ভরতা নিছক স্লোগান নয়। আত্মনির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠল পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ উৎসব মুখর। আলোকমালায় সজ্জিত দিগন্ত ছোঁয়া পদ্মার এপার ওপার। গড়ে উঠেছে পান্থশালা ‘ইলিশ’। ইলিশের গন্ধে রসনাময় পরিবেশ। শুরু হয়েছে বিস্ময় সেতু অবলোকনের স্টিমার সফর। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আমরা জনা দশেক সাংবাদিক পদ্মা সেতু দেখতে এসেছিলাম।
এটা বাংলাদেশের আর্থিক স্বাধীনতার যুদ্ধ। বিশ্বে বহু সেতু নির্মিত হয়েছে। তার সঙ্গে তেমন হয়তো কাহিনীর যোগ নেই। এই পদ্মা সেতুর সঙ্গে । সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ষড়যন্ত্র রহস্য- চক্রান্ত লোমহর্ষক বললেও অত্যুক্তি হয় না। আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে সেতু যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করবেন। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন দেশের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত হবে পূর্ব ও উত্তর। বাংলাদেশের আর্থিক বিকাশে এই সেতু যোগ করবে আরো দেড় থেকে দুই শতাংশ। বাংলাদেশের আরেক বিস্ময় ককসবাজারের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। ১২০ দীর্ঘ প্রাকৃতিক সৈকত। বিশ্বে এই মাপকাঠিতে বিশ্বের দীর্ঘতম। নতুন বিস্ময় পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রযুক্তির দিক থেকে এমন ইতিহাস তৈরি করেছে তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়। প্রায় পাঁচশো ফুটের স্প্যান খরস্রোতা পদ্মার প্রশস্ত বক্ষে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দৈর্ঘ্যে ৬ কিলোমিটারের একটু বেশি।
এই সময়ে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। সবথেকে বড় স্তম্ভটির দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুটের গভীরে পদ্মার বুক চিরে। এটাও বিশ্বের মধ্যে প্রথম। গঙ্গা নদীতেও এতো বড় স্তম্ভ বসানো হয়নি। এটি দ্বিতল সেতু। উপরিতলায় ছয় লেন সড়ক পথ এবং নীচে রেল পথ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ঘনমিটার জল প্রবাহিত হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সিদ্ধান্ত নেন পদ্মা নদীর উপর অভিকায় সেতু তৈরি করাবেন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে প্রাক যোগ্যতা বরাত আহ্বান করে। বিশ্বব্যাংক দশহাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আচমকা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্প টি বাতিল করে দেয়। বিশ্বব্যাংক বিবৃতি দিয়ে জানায়, তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পদস্ত কর্মী এবং কানাডার ইঞ্জিনীয়ারিং সংস্তা এসএনসি-লাভলিন যোগসাজস করে দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত। হাসিনা সরকার তাঁকে পদত্যাগ করান। তাতেও বিশ্বব্যাংক ঋণ অনুমোদনে সম্মতি দেয়নি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন শাখা এবং আদালত তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। কানাডার আদালতেও মামলা হয়। ২০১৭ সালে কানাডার বিচারপতি আয়ান নরধেইমার মামলাটি খারিজ করে দেন এই বলে কানাডার রয়্যাল পুলিশের কাছে কোনো প্রমাণ নেই দুর্নীতির।
পদত্যাগী মন্ত্রী হোসেন বিবৃতি দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংক কায়েমি স্বার্থের চাপে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল। আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করা। হাসিনা পুত্র জয় ওয়াজেদ ও বলেন, যাঁরা অভিযোগ এনেছিলেন তাঁদের উচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। একই কথা বলেন আর্থিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।
বাংলাদেশ সরকার সন্দেহ করে বিরোধী দল এবং পশ্চিমী শকতি বাংলাদেশ সরকারকে পছন্দ করছে না। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে আবেগপূর্ণ ভাষণে পদ্মা সেতু নির্মাণকে মুক্তিযুদ্ধের সাঙ্গে তুলনা করে বলেন, “ওঁরা আমাদের ভিক্ষা চাইতে বলছে। আমাদের গিনিপিগ করে রাখতে চায়। ওঁদের জানিয়ে দিতে চাই, আমরা কারোর দয়ার উপর নির্ভর করবো না। নিজেদের ক্ষমতায় সেতু করে গোটা বিশ্বকে দেখি য়ে দেবো ইনশাল্লাহ। সত্যিই আজ দেখিয়ে দিলেন। ততদিনে সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। হাসিনা পদ্মা সেতুর নামে কর বসালেন। বস্তু ছাড়লেন। অনাবাসী বাংলাদেশীরা যোগদান করলো এই জাতীয় প্রকল্পে। এখানে বলা দরকার- গোটা বাংলাদেশ এই সেতু নির্মাণে যোগ দিলো। ফের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে। বিশ্বে যতগুলি খরস্রোতা নদীর উপর সেতু রয়েছে তার অধিকাংশই চিনে। এই প্রযুক্তি অন্য দেশের,এমনকি ভারতেরও নেই। প্রথনে চিনের চারটি সংস্থা এগিয়ে আসে। তারা বিগুটি বা বিল্ট অপারেট ও ট্রান্সফার পদ্ধতিতে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। সেতু নির্মাণের এমনকি সত্তুর শতাংশ ঋণেরও প্রস্তাব দেয়। হাসিনা সরকার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। বরং পাল্টা প্রস্তাব দেয় চিনা প্রযুক্তি সংস্থা সেতু নির্মাণ করতে পারে। তার সম্পূর্ণ ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন স্বল্প উন্নত দেশে এই ঋণ ফাঁদ তৈরি করতে পারে। তাই রাজি হননি। যে কারণে নিকট প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ভারত এতে কোনো পরোক্ষ আপত্তি তোলেনি। শেষ পর্যন্ত চিনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে ২০১৪ সালের ১৭ জুন সেতু নির্মাণের বরাত দেওয়া হয়। প্রকৃত কাজ শুরু হয় নভেম্বর মাসে। ঠিক আট বছর পর সেতুটির নির্মাণ সম্পন্ন। সেতু নির্মাণের মধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারপতি লুইস গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো। তিনি সেতু নির্মাণের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেন এবং তিন উচ্চপদস্থ অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করেন। যদিও কানাডা নির্দোষ আখ্যা দেয়।
আদালত তাঁদের সেতুর কাজ যখন জোর কদমে চলছে তখন আচমকা ফেসবুকে গুজব ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন। নইলে সেতু পোক্ত হবে না। বাংলাদেশে রীতিমতো অশান্তি ছড়িয়ে যায়। পুলিশ গ্রেফতার করে কয়েকজনকে। তারপর সেতু কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে হয় এসব গুজব। গবেষকদের বলা হয় প্রকৃত তথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে। প্রভাবশালী শক্তি থেকে সামাজিক অসন্তোষের মোকাবিলা করে হাসিনা সরকারকে এগোতে হয়। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের সুবিধা কি? বিশেষ করে কলকাতার। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য চারশো কিমি পথ অতিক্রম করতে হতো। পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে দেড়শো কিমি কম হয়ে যাবে। অর্থাৎ মাত্র আড়াইশো কিমি। ছঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। এখন কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস নদীয়া হয়ে গেদে যায়। তারপর সীমান্ত পেরিয়ে দর্শনা স্টেশন। দশঘন্টা লাগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে। পদ্মা সেতুতে রেল পথ চালু হলে কলকাতা থেকে বনগাঁ স্টেশন থেকে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনাপোল। তারপর যশোর নড়াইল ফরিদপুর হয়ে ঢাকা। এটা ২৫০ কিমি। এটা কেবলমাত্র কলকাতার সুবিধা নয়। বাংলাদেশের বরিশাল ও খুলনা থেকে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বিপ্লব আনবে পদ্মা সেতু। এর ফলে বঙ্গোপসাগরের তীরের মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব একশো কিমি কম হবে। এই দুই বন্দর ভারতে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে গুলির বাংলাদেশ সরকার। ফলে ভারতের স্থলবন্দি উত্তরপূর্ব রাজ্য সঙ্গে যোগাযোগ সুগম হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন দক্ষিণ পশ্চিমের ২১ টি জেলায় শিল্প বিপ্লব দেখ । দিতে পারে। এখন ঢাকা থেকে বরিশাল বা খুলনায় পণ্যবাহী ট্রাকের যেতে দু তিনদিন লেগে যায়। পদ্মা সেতুর পরে একদিনেই যেতে পারবে।
প্রথমবার ক্ষমতা আসার পর ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা যমুনার উপরে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করেছিলেন। তখন উত্তরবঙ্গে কার্যত শিল্প বিপ্লব হয়ে জাতির বিকাশ দরে দুই শতাংশ বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল সেই সেতু। পদ্মা সেতু তার থেকেও বেশি যোগদান করাবে অর্থনীতিতে। দক্ষিণ পশ্চিমে আরো । একটি শিল্প বিপ্লবের মুখে বাংলাদেশ ঢাকা থেকে যাতায়াতের সময় দশ শতাংশ কম হওয়ায় জেলার অর্থনীতিতে বৃদ্ধি হবে পাঁচ শতাংশেরও বেশি। এটা জাপানি জাইকার বিশ্লেষণ। এক সমীক্ষা অনুযায়ী খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে দারিদ্র্যের পরিমাণ জাতীয় গড়ের থেকে দশ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতুর পর কমপক্ষে এক শতাংশের বেশি দারিদ্র্য কমবে। জাতীয় গড়ে কমবে এক শতাংশের কিছু কম। পদ্মা সেতু গোটা দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে।