Last Updated on May 13, 2023 7:55 PM by Khabar365Din
৩৬৫ দিন। বেঙ্গালুরু। আমি অপরাজেয়। আমি আত্মবিশ্বাসী। এবং হ্যাঁ, আজকে আমি অপ্রতিরোধ্য। কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের গণনা শুরু হওয়ার পরে ভাজপাকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করা মাত্র কংগ্রেসের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে রাহুল গান্ধীর ভারত যাত্রায় হেঁটে যাওয়ার ছবি পোস্ট করে লেখা হলো এই তিনটি বাক্য। কারণ এই কর্নাটকেই গত লোকসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোদী পদবী নিয়ে মন্তব্য করায় গুজরাতের আদালতের রায়ে সাংসদ পদ খারিজ হয়েছে রাহুল গান্ধীর। সাজা হয়েছে দু বছরের কারাদন্ডের। তারপরেও কর্নাটকের মানুষ বিমুখ করেনি কংগ্রেসকে। খালি হাতে ফেরায় নি রাহুল গান্ধীকে।
২০১৮ সালের কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে এককভাবে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে জনতা দল সেকুলারের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়লেও ভাজপা অপারেশন লোটাস চালিয়ে বছর ঘোরার আগেই ফেলে দিয়েছিল সেই সরকার। কিন্তু কর্ণাটকের মানুষ যে বিগত ৪ বছর ধরে চলা ভাজপা সরকারকে মেনে নিতে পারেনি তার প্রমাণ দিয়ে স্পষ্ট জনাদেশে ২২৪ আসন বিশিষ্ট কর্ণাটক বিধানসভায় প্রয়োজনীয় ম্যাজিক ফিগার ১১৩ আসনের থেকে অনেক বেশি আসনে কংগ্রেসকে জয়ী করে বুঝিয়ে দিয়েছে রাজ্যপাল ম্যানেজ করে অথবা বিধায়ক কেনাবেচা করে সরকার ক্ষমতা দখল করা গেলেও জনাদেশ বদলে দেওয়া যায় না। তা সে খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সহ গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা উঠে এসে নির্বাচনী প্রচারে নামলেও!
স্পষ্ট জনাদেশে ম্যাজিক ফিগার ছাড়ালো কংগ্রেস
গত ১০ মে কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পরেই দেশের তাবোড় নিউজ চ্যানেল এবং সমীক্ষা সংস্থাগুলি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করেছিল এক্সিট পোল বা বুথ ফেরত সমীক্ষা। যার মধ্যে ৯৫% সমীক্ষাতেই বলা হয়েছিল কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কোন একটি দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেবে না। কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি গেলেও কর্নাটক বিধানসভা হবে ত্রিশঙ্কু। স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত সমীক্ষা সংস্থার রিপোর্ট দেখে উল্লংসিত হয়ে ভাজপা নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে শুরু করেছিলেন ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলেও সরকার গড়ব আমরাই। কিভাবে সরকার গড়তে হয় তার জন্য প্ল্যান বি রেডি রয়েছে আমাদের। অন্যদিকে ত্রিশঙ্কু বিধান সভায় নিজেদের দর বাড়ানোর জন্য নিজেকে কিং মেকার ভেবে দর কষার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিলেন জনতা দল সেকুলার কর্ণধার এইচডি কুমারস্বামী।
চূড়ান্ত ব্যর্থ মোদির ৩৫ নির্বাচনী প্রচার
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক যেভাবে বাংলায় কার্পেট বোম্বিং করার স্টাইলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিল ভাজপা, ঠিক সেভাবেই এবারে কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনকে টার্গেট করেছিল ভাজপা। সেইজন্যে অশান্তির আগুনে মনিপুর দিনের পর দিন জ্বলতে থাকলেও সেই বিষয় একটি শব্দ খরচ না করে কর্ণাটকের নির্বাচনী প্রচারে পড়ে থেকেছেন খোদপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। দক্ষিণ ভারতের কোন রাজ্যের নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে শুধুমাত্র কর্ণাটকেই নরেন্দ্র মোদি ২০ নির্বাচনী জনসভা করেছেন, রোড শো এবং অন্যান্য নির্বাচনী প্রচার মিলিয়ে মোদির মোট নির্বাচনী প্রচারের সংখ্যা এখানে ৩৫। গত চার বছর ধরে কর্নাটকের ক্ষমতায় থাকার পরেও শোচনীয়ভাবে পর্যূদস্ত হয়ে কর্ণাটকের ভাজপা নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য এই পরাজয়ের দায় নিতে হবে মোদীকেই। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, এএটা তো মোদীর হার। কংগ্রেস ওখানে জিতেছে। এর ফলে চব্বিশের আগে মহাজোটের সম্ভাবনা বাড়ল।
দাক্ষিণাত্যে ব্রাত্য ভাজপা
তামিলনাড়ু হোক অথবা তেলেঙ্গানা, কেরালা হোক বা কর্ণাটক – নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে দাক্ষিণাত্যের কোন রাজ্যেই গত প্রায় এক দশক কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছাতে পারেনি মোদির ভাজপা। আজকের কর্ণাটক বিধানসভার ফল ঘোষণার পরে কার্যত ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ ভারত থেকে মুছে গেল ভাজপা। পূর্ব ভারতের বাংলা বিহার ওড়িশা ও ঝাড়খন্ডে আগেই রয়েছে ভাজপা বিরোধীদলগুলির শাসন। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু অন্ধ্রপ্রদেশ তেলেঙ্গানা কেরালার পরে কর্নাটক থেকেও ভাজপার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রার সাফল্য কর্ণাটক
আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে গোটা দেশ জুড়ে ভাজপা বিরোধী শক্তি গুলিকে একজোট করার পাশাপাশি দলের সংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন রাহুল গান্ধী। রাহুল গান্ধী কর্নাটকে ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন ৩ ধাাপে। তিনি কর্নাটকে ৫০০ কিমির বেশি যাত্রা করেছিলেন। রাহুল গান্ধীর এই যাত্রা কর্নাটকের ৭ লোকসভা এবং ২০ বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে যায়। ওই যাত্রার পরে কর্নাটকে দুটি স্থানীয় নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলেও বিধানসভা নির্বাচনে সফল তারা। কর্নাটক কেন সারা দেশে দক্ষিণ থেকে উত্তরে ভারত জোড়ো যাত্রা পরে এটা কংগ্রেসের প্রথম বড় জয়। প্রসঙ্গত ভারত জোড়ো যাত্রার সময় রাহুল গান্ধী কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার হাত ধরে দৌড়েছিলেন।
রাহুলের পাশাপাশি কংগ্রেস সভাপতি পদে বসার পরে মল্লিকার্জুন খাড়গে জান প্রাণ লড়িয়ে দিয়েছিলেন কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে। কারণ তিনি কর্ণাটকের ভূমিপুত্র। ভূমিপুত্র কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে এটাই ছিল কর্নাটকের প্রথম বড় নির্বাচন। এই ভূমিপুত্র প্রচারও নির্বাচনী জয়ের অন্যতম কারণ।
কেন মুখ থুবড়ে পড়ল ভাজপা
২০১৮-র নির্বাচনে প্রথমে ১০৪ থেকে পরে ১১৬-তে পৌঁছয় ভাজপা। সেখান থেকে একধাক্কায় ৭০-এ নেমে যাওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে। ভাজপা নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়কে নিজের কাছে রাখতে পারেনি। এছাড়াও দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, ভোক্কালিগারা ভাজপার থেকে মুখ ফিরিয়েছে। অপরদিকে কংগ্রেস মুসলিমদের পাশাপাশি এইসব সম্প্রদায়কে নিজেদের দিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাখতে পেরেছে। কর্নাটকের ভাজপা নেতারা গত একবছর ধরে হালাল, হিজাব, আজান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মুসলিম মহিলাদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ করেছে কর্নাটকের ভাজপা সরকার। ভাজপা শীর্ষ নেতৃত্ব কর্নাটকের প্রচারে ক্রমাগত ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি ভাজপার পরাজয়ের পিছনে রয়েছে দুর্নীতি। কংগ্রেস প্রথম থেকেই ভাজপার বিরুদ্ধে ৪০ শতাংশ কমিশন নিয়ে প্রচার করেন। রাহুল গান্ধী প্রতিটি সভায় ৪০ শতাংশ কমিশনের কথা বলেছেন।
বিধায়ক কেনাবেচা রুখতে রিসর্ট রাজনীতি
২০১৮ সালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারে ভোট গণনা শুরু হওয়ার আগেই দলের সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীদের তড়িঘড়ি বেঙ্গালুরুতে আসার জন্যই হুইপ জারি করেন কর্নাটক কংগ্রেস সভাপতি শিব কুমার। আজ সকাল থেকে কংগ্রেস এগোতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সব প্রার্থীদেরই বেঙ্গালুরুতে তলব করা হয়েছে। বিধায়কদের হিল্টন হোটেলে ক্যাম্প করে রাখা হবে বলে জানা গিয়েছে। তারমধ্যে কর্নাটক কংগ্রেসের প্রধান ডিকে শিবকুমার জয়ী হয়েছেন কনকপুরা কেন্দ্র থেকে।